মাকে বৃদ্ধাশ্রমে নয়, নিজের কাছেই রাখুন
মায়ের স্থান বৃদ্ধাশ্রম নয়, নিজের বাড়ি। কেননা মা-ই আপনাকে বাড়িতে বড় হতে দিয়েছেন, খাবার খাইয়েছেন, আদর-যত্ন করেছেন। রোগের সময় সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। কখনোই বিরক্ত হয়ে আপনাকে ত্যাগ করে যাননি। সুতরাং মা যখন বৃদ্ধ হয়েছেন, তার প্রতি আপনিও অনুরূপ আচরণ করুন।
কেননা পরিবারে এখন পর্যন্ত যারা নিরলস পরিশ্রম করেন, তারা হলেন মা। মায়ের কোনো ক্লান্তি নেই। অবসর নেই। ভোরের আলো ফুটতেই তাদের ঘুম ভাঙে, আর সবার শুতে যাওয়ার পর তিনি বিছানায় যান। এককথায় মায়ের নিদ্রা এবং জাগরণ সবার সব চাহিদা মিটিয়ে তারপর। তিনি নিজের কথা ভাবার অবকাশই পান না। তার শারীরিক অসুস্থতা যতই থাক না কেন, তিনিই পরিবারের একমাত্র কাজের ভারপ্রাপ্ত মানুষ। তার শরীরে শক্তি নেই, শরীর ক্লান্ত বা জ্বর-জ্বালা এটা বলার মতো সুযোগই তার হয়ে ওঠে না। তিনিই একমাত্র অতন্দ্র প্রহরী একটি পরিবারের জন্য। একটি পরিবারকে সুগঠিত করতে, ঠিকভাবে চালনা করতে মায়ের ত্যাগের কথা বলে শেষ করার মতো নয়! তবু আমাদের সমাজে মায়েদের কাজের স্বীকৃতি নেই! মায়ের কাজকে অধিকাংশ মানুষই গুরুত্ব দেয় না।
মা না থাকলে সেই পরিবার অন্ধ। কানা গলিতে হাতড়ে বেড়ানোর মতো তাদের অবস্থা দাঁড়ায়। মায়ের অবদান তাই অনস্বীকার্য। একজন মা যত ক্লান্ত থাকুন কেন, তিনি যত অসুস্থই হন না কেন, সারা দিনের কাজ শেষে তার জন্য কোনো সময় বাঁচে না। যখন তিনি ঘুমানোর জন্য মন স্থির করছেন, তখনো তার মাথায় চিন্তারা ঘুরপাক খেতে থাকে। স্বামীকে কী টিফিন দেবেন, সন্তানদের কী নাশতা দেবেন, তাদের পড়াশোনার অগ্রগতি কতটা, শ্বশুর-শাশুড়ি-ননদ-জা আত্মীয়স্বজন কার সঙ্গে কীভাবে আত্মীয়তা রক্ষা করতে হবে, আগামীকালের খাবার তালিকায় কোন সবজি-মাছটা রাখবেন, তার মধ্যে সন্তানদের চাহিদা পূরণ হবে কি না, এ রকম নানাবিধ জল্পনা-কল্পনা তার থাকেই। দিবানিশি শতভাগই কাজের ছকে বাঁধা মায়েরা। অবসরের ছিটেফোঁটাও তার জন্য নেই। কোনো অজুহাত, কোনো তদবির তিনি করেনও না কখনোই। কারণ তিনি মা।
এই মাকেই স্বামীর সংসারে রোবটের মতো যান্ত্রিক জীবন পালন করতে হয়। শারীরিক অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে তার কাজের কিঞ্চিৎ ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটলেই পুরুষতন্ত্রের কটুকথায় প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়। যে পরিবার-পরিজনের জন্য তিনি দিনান্ত খেটে চলেছেন এক ধাক্কায় তার সবটা ম্লান করতে অধিকাংশেরই বিবেকে বাধে না। তবু এই মা কিন্তু সবার ঊর্ধ্বে উঠে নিজের দায়িত্ব-কর্তব্য-ভালোবাসা-মমত্ব-আদর-আহ্লাদে স্বামী-সন্তান-সংসারকে আগলে রাখেন। তাদের গায়ে আঁচড় পড়ার আগে মা নিজের বুক পেতে দেন। এই মহীয়সী মায়ের অবদান কোনো দিনই পরিমাপ করার নয়। মায়ের অবদান শুধু মায়ের প্রতি ভালোবাসা-শ্রদ্ধা-সম্মান আর তার কাজের মূল্যায়নই হতে পারে।
একজন গর্ভবতী মাকে নিজের সন্তানের কথা ভাবতে হয়। কী করলে তিনি সুস্থ সন্তান জন্ম দিতে পারবেন তার জন্য মায়ের সঙ্গী মা নিজেই। পরম মমতায় গর্ভে লালন করেন সন্তানকে। এই সন্তানকে তিনি যখন পৃথিবীর আলো দেখাচ্ছেন তখনো তার দায়িত্বের কমতি নেই! রাত-দিন তাকে বড় করে তোলার সর্বোচ্চ প্রয়াস থাকে মায়ের। সন্তানকে ঘিরে কল্পনার জগৎ সাজাতে ব্যস্ত থাকেন মা। রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে সন্তানের কাপড় বদলানো, বাথরুম করানো, খাওয়ানো সবই মাকে করতে হয়। ধীরে ধীরে সন্তান বড় হতে থাকে মায়ের দায়িত্ব-কর্তব্য বাড়তে থাকে। কোনো দিনই সন্তান স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত মায়ের ছুটি হয় না। বলা চলে, মা যত দিন পৃথিবীতে থাকেন তত দিন মায়ের ছুটি নেই। একটি বয়সের পর হয়তো তিনি সন্তানের জন্য শারীরিক শক্তি দিয়ে ততটা করতে পারেন না। তবু মায়ের কাজ আটকে থাকে না। শারীরিকভাবে যখন সমর্থন করতে না পারেন, তখনো তিনি সন্তানের চলার পথের মানসিক শক্তি সৃষ্টিকারী। সন্তানকে সৎ-সঠিক পরামর্শ দিয়ে তাকে সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দিতে প্রাণটা পর্যন্ত বিসর্জন দিতেও মা দ্বিধা করেন না। মায়ের অবদান-ভালোবাসা সুখের স্বর্গ গড়ে তোলে।
ছোট্ট থেকে সন্তানকে কোলেপিঠে করে মানুষ করার পর এই সন্তানই একদিন বড় হন। মায়ের প্রতি তার অবজ্ঞা-অবহেলা বাড়তে থাকে। আর অনেক সন্তান মায়ের এত ত্যাগ স্বীকারও করেন না। তখন মায়ের দুঃখের সীমা থাকে না। কারণ মায়েরা তো সন্তানের কাছে টাকা-গাড়ি-বাড়ির সুখ চান না। তিনি চান তার সন্তান দিন শেষে মায়ের জন্য অন্তত দুটো মিনিট সময় রাখুক। কাছে যাওয়ার ক্ষমতা না থাকলে অন্তত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে অন্য উপায় অবলম্বে মাকে কাছে টেনে নিক। এত ছাড় দিয়েও অনেক মায়ের ভাগ্য এই কিঞ্চিৎ সুখের দেখাও মেলে না! তাই তো আজকাল বৃদ্ধাশ্রমের শেষ নেই। মায়েদের হৃদয়ের হাহাকার, কান্না শোনার তাগিদ নেই সন্তানের! কিন্তু এই মা-ই সন্তানকে লালন-পালন করেছেন খেয়ে-না খেয়ে। গাধার খাটুনি খেটেছেন, যাতে সন্তান মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
সন্তানের জন্য তো মায়ের পুরো জীবনটাই বিসর্জন দিতে হয়। শখ-আহ্লাদ-স্বপ্নও৷ তাই তো অনেক মা নিজের লালিত স্বপ্নগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করেন সন্তানের মধ্যে দিয়ে। তিনি যা পারেননি, তার ইচ্ছে থাকলেও যা করা হয়ে ওঠেনি সেই মৃতপ্রায় স্বপ্নগুলোকে জীবিত রূপ দিতে চান সন্তানের মাধ্যমে। আর তাই তো শ্রম-মেধা-একাগ্রতা দিয়ে পাশে থাকেন সন্তানের। প্রত্যেক সন্তানের উচিত দিন শেষে মায়ের কাছে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করা। মাকে অন্তর থেকে ভালোবাসা৷ মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে কথা বলা। এই মা-ই তো ভুবন। নাহলে কীভাবে সম্ভব হতো পৃথিবীর আলো দেখা। কীভাবে সম্ভব হতো ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা! মায়ের জগৎ তৈরি হয় সন্তানকে ঘিরে। তবু দিন শেষে মায়ের কাজের মূল্যায়ন হয় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে!
বর্তমানে অনেক মা ঘরে-বাইরে উভয়ই সামলাচ্ছেন। চাকরি করে ঘরে পৌঁছে সন্তান এবং স্বামীর চাহিদা পূরণ করছেন। তাদের জন্য সময় দিতে পারছেন কি না, সেটা নিয়ে মায়ের দুশ্চিন্তার শেষ নেই! অনেক মা আবার এসব নিয়ে মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্বেও ভোগেন! কিন্তু পাশের পুরুষ সদস্যটি অর্থাৎ স্বামীটির কিন্তু এত দায় কোথাওই পরিলক্ষিত হয় না। তিনি বাইরের কাজ সারতে পারলেই নিজেকে মহারাজা ভাবেন। বাড়ি ফিরে তার তর্জন-গর্জন আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু স্ত্রীটিরও যে অবসর প্রয়োজন সে কথা ভাবতেও ভুলে যান! শুধু কি চাকরিজীবী নারীর ক্ষেত্রেই এমন, তা নয়; বরং যিনি গৃহকর্মে নিপুণা নারী, ঘর-গৃহস্থালির কাজে সময় ব্যয় করেন; তিনি হলে তো কথায় নেই! পুরুষতন্ত্র তো তাকে এককথায় খারিজ করে দেন। তার কাজের যেন কোনোই মূল্যায়ন হয় না এ শ্রেণির কাছে! কিন্তু একবারও কি কেউ ভেবে দেখেছেন ওই নারীটি অর্থাৎ ‘মা’ ছাড়া পরিবারটির অবস্থা কেমন হবে? বেশি নয় একটি দিনের কথা স্মরণ করে দেখুন তো। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি মা যে ধরনের কাজ করেন, তার সবটার দায় আপনার ঘাড়ে। কেমন হবে তখন! তবু কেন মায়ের প্রতি অধিকাংশের মমত্ব নেই। শ্রদ্ধা নেই!
পরিবারকে সংগঠিত করতে যেই মা নিজেকে বিলিয়ে দেন, তার ওপর পুরুষতন্ত্রের আক্রোশ এবার বন্ধ হোক। মাকে সম্মান করুক সন্তান। কাজের মূল্যায়ন করতে শিখুক স্বামী-সন্তান। যাতে অন্তত মায়ের এটুকু সান্ত্বনা থাকে তিনি যাদের জন্য নিজের সর্বোচ্চটা দিচ্ছেন তারা তা অনুভব করতে পারে। বুঝতে সক্ষম হয়েছে মায়ের ত্যাগ। এতেই একজন মায়ের প্রাণে সার্থকতার সুমিষ্ট হাওয়া বয়ে যাবে নিশ্চিত।
তাই মায়ের প্রতি অন্তত একটু কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। ভালোবাসায় আগলে রাখুন। গর্ভে ধারণ করে তিনি আপনাকে পৃথিবীতে এনেছেন, তার প্রতি আপনার অশ্রদ্ধা প্রকাশ করা অন্যায় এবং মহাপাপ। মায়ের সঙ্গে কোনো কিছুর তুলনা চলে না। হয় না। মায়ের বিকল্প কিছু নেই। তাই সন্তানের উচিত মায়ের কাজের মূল্যায়ন করা। শিশুকালে যেমন মা আগলে রেখেছেন, ঠিক তেমনি বাকিটা জীবন আগলে রাখা। সব মা-ই জ্ঞানের আধার। তাকে যোগ্য সম্মান এবং মূল্যায়ন করতে হবে। আজ ১৪ মে। বিশ্ব মা দিবস। পৃথিবীর সব মায়েদের প্রতি হৃদয়ের অন্তস্তল থেকে শতকোটি প্রণাম। মায়েরা তাদের মমতায় আগলে রাখুন পৃথিবী।