চিফ হিট অফিসার বুশরাকে নিয়ে কেন এত বিকৃত রুচিচর্চা
সম্প্রতি বুশরা আফরিন ঢাকার ‘চিফ হিট অফিসার’ নিযুক্ত হয়েছেন। ঘটানাটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর একশ্রেণির মানুষ এটাকে বিশেষ রঙচঙ মাখিয়ে প্রকাশে ব্যস্ত ! কেউ আবার কড়া মন্তব্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম সরগরম করে ফেলেছেন! কিন্তু অধিকাংশই চিফ হিট অফিসার সম্পর্কে পূর্ণ ধারণা না রেখেই নিজেদের মনগড়া কিছু মন্তব্য ছুড়ে দিয়েছেন নারীটির প্রতি। অবশ্য এর নেপথ্যে রয়েছে, প্রথমত তিনি নারী; দ্বিতীয়ত তিনি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র জনাব আতিকুল ইসলামের কন্যা।
ফলে চিফ হিট অফিসার নিযুক্ত হওয়ার পর এই নারীটির প্রতি সমাজের কদর্য, বিকৃত মানসিকতার সর্বোচ্চ প্রকাশ ঘটছে। এমন ঘটনা প্রমাণ করে, পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করা খুব একটা সহজ কাজ নয়! কারণ অনেকেই নারীটিকে ‘হিট অফিসারে’ কোট- আনকোট করে বিকৃত যৌন সুড়সুড়ির প্রসঙ্গ উপস্থাপন করছেন। নারীটির কিছু ব্যক্তিগত ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করেছেন। বুশরা আফরিনের পর অনেকেই কুলিং অফিসার নিযুক্ত করার প্রসঙ্গও উপস্থাপন করেছেন। এর ফলে সহজভাবেই বোধগম্য হয় যে, এ সমাজ নতুন বা জানার বাইরের কিছু সহজে গ্রহণ করার মতো মানসিকতা পোষণ করে না। পরন্তু আরও একটি কথা বিশেষভাবে গণ্য হচ্ছে যে, ‘খ্যাতির বিড়ম্বনা’। বাবার খ্যাতি বা পরিচিতির কারণে নারীটিকে সমাজের চোখে হেয় করা হচ্ছে! বিভিন্নভাবে নারীটির ব্যক্তি স্বাধীনতায় আঘাত হানা হচ্ছে! কিন্তু এই বিকৃত মানসিকতা কেন?
ভারতীয় জনপ্রিয় তথা বনেদি গণমাধ্যম ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’। বুশরা আফরিন হিট অফিসার নিযুক্ত হওয়ায় তারা তাদের পত্রিকার পাতায় তার কিছু ছবি প্রকাশ করেছে। একইসঙ্গে ফেসবুক পেজে খবরটি শেয়ার দেওয়ার সময় ক্যাপশন দিয়েছে, ‘আহা কত উত্তাপ’। এখন প্রশ্ন হলো ভারতীয় একটি শীর্ষ পত্রিকায় একজন নারীকে নিয়ে এ ধরনের বাজে এবং বিকৃত যৌন সুড়সুড়িমূলক শিরোনামের অর্থ কী?
দ্বিতীয়ত, গণমাধ্যম জনগণকে সৌন্দর্যবোধের- মনুষ্যত্বের শিক্ষা প্রদান করে। সেই জায়গায় একটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকা মানুষের মধ্যে কী ধরনের বার্তা প্রেরণ করছে! বুশরা আফরিনের মতো নারীরা যদি এ সমাজে এভাবে বিভৎসতার শিকার হন তবে সেখানে সাধারণ নারী তো নস্যি।
আনন্দবাজার পত্রিকার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে এই বিকৃত মানসিকতা প্রকাশের জন্য বুশরা আফরিনের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। একইসঙ্গে এ ধরনের যৌন সুড়সুড়িমূলক শিরোনাম দ্রুত সরিয়ে ফেলা উচিত। নারীর প্রতি এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি সৃষ্টি সমাজের জন্য কখনোই কাম্য নয়। তবু গণমাধ্যমগুলো নারী সম্পর্কীয় কোনো ইস্যু পেলেই সেটাকে যতটা সম্ভব মুখোরোচক করে উপস্থাপন করে! নারীর প্রতি যদি একটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা এ ধরনের উত্তাপ ছড়ানোর কাজে নিযুক্ত হয়ে থাকেন, তবে তাদের তো আর সংবাদ প্রকাশ করে লাভ নেই। অন্যকাজে নিযুক্ত হওয়ার কথা তারা অবশ্যই ভেবে দেখতে পারে। বেশ কয়েক বছর যাবৎ আনন্দবাজার পত্রিকার এসব নোংরামি জনমনে বেশ ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে।
এখন আসা যাক নারীর প্রতি এত আক্রোশ কেনো যেখানে হিট অফিসার নিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি কার ওপর নির্ভরশীল। এই তথ্য অনেকেই হয়তো জানেন না, বিষয়টি পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মহলের ওপর নির্ভরশীল।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অ্যাড্রিয়েন আর্শট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টার (আর্শট-রক) বিশ্বের বিভিন্ন শহরে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় তাদের কাজের অংশ হিসেবে চিফ হিট অফিসার নিয়োগ করে। তাদের প্রথম চিফ হিট অফিসার নিয়োগ পায় ২০২১ সালে।
বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিয়ামি, লস অ্যাঞ্জেলেস, চিলির সান্টিয়াগো, সিয়েরা লিওনের সান্টিয়াগো, গ্রিসের এথেন্স, অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরে চিফ হিট অফিসার রয়েছে। বুশরার মতো তাঁরা সবাই নারী। সবশেষ ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পান বুশরা আফরিন। যিনি এশিয়ার কোনো শহরের প্রথম চিফ হিট অফিসার।
চিফ হিট অফিসার পদে কেন শুধু নারীদের নিয়োগ দেওয়া হয় এ প্রশ্নের জবাবে অ্যাড্রিয়েন আরশট-রকফেলার ফাউন্ডেশন রেজিলিয়েন্স সেন্টারের পরিচালক ক্যাথি বাগম্যান ম্যাকলর্ড বলেন, চিফ হিট অফিসার প্রকল্পের পরিকল্পনাটা এসেছে তাঁর মাথা থেকেই। তিনি বলেন, এই পদে শুধু নারীদের নির্বাচিত করা হয়। কারণ, চরম তাপমাত্রার বড় শিকার নারী ও মেয়েশিশুরা। ফলে এখন পর্যন্ত যতজন চিফ হিট অফিসার নিযুক্ত হয়েছেন তাদের সবাই নারী।
তীব্র তাপপ্রবাহের ফলে সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলা এবং নগরে ‘হিট আইল্যান্ডে’র প্রভাব কমানোর জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নেওয়া এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন করেন চিফ হিট অফিসার। কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি সংস্থা, ব্যক্তি, নাগরিক সমাজ, দাতাসংস্থাসহ সব পক্ষকে সম্পৃক্ত এবং সমন্বয় করার দায়িত্ব তার। চিফ হিট অফিসারের আওতায় যেসব কাজ হবে, সেগুলোর অর্থায়ন করবে আর্শট-রক। এছাড়া চিফ হিট অফিসারের বেতনসহ সব খরচ তারাই দেবে। এরপরও জনসাধারণের মধ্যে এ ধরনের কথাবার্তা অশনিসংকেত সৃষ্টিকারী।
সমাজে শিক্ষিত, অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত সবাই একই স্রোতে যদি গা ভাসায় তবে এ সমাজ নিয়ে আরও উৎকন্ঠা- উদ্বেগ প্রকাশ ছাড়া গত্যন্তর নেই। যখন যেই ট্রেণ্ড আসে তখন সেটাকেই ইস্যু বানিয়ে একশ্রেণির অবিবেচক মানুষজন বিকৃত তৃষ্ণা মেটাতে উঠেপড়ে লাগেন। কোনো বিচার- বোধ- যুক্তি-তর্ক ছাড়াই তারা কামুক উল্লাসে মেতে ওঠেন। আর অবশ্যই ইস্যুটা যদি নারী ঘটিত হয় তবে তো কথায় নেই! একবারও ভেবে দেখেন না যে, মানুষের বাহ্যিক জীবনের পাশাপাশি তার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে। সেখানে এসব অনাকাঙ্ক্ষিত কথাবার্তা, আচরণ, কুৎসা কতটা আঘাত হানতে পারে!
বুশরা আফরিন আপামর নারী থেকে ভিন্ন নন। তাই একজন নারীকে এভাবে অপদস্ত করা ব্যাপকার্থে প্রত্যেক নারীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর সামিল! এক্ষেত্রে তার প্রতি এ ধরনের অনৈতিক, অশোভন, অযৌক্তিক এবং কদর্য প্রকাশ সমাজের বিকৃত মানসিকতারই বহিঃপ্রকাশ। নারীর প্রতি এত কদর্য, যৌন সুড়সুড়িমূলক প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হোক। যুক্তি ও মূল্যবোধ জাগ্রত হোক মানুষের মধ্যে। হঠাৎ কোনো ঘটনা- পরিস্থিতি তথা অবস্থান সম্পর্কে না জেনে-বুঝে আর কত এ ধরনের হিংস্র মন্তব্য! নারীর প্রতি একটু নম্রতা প্রকাশে বাধা কোথায়! আর কত নিচে নামবে সমাজ-গণমাধ্যম-জনগণ! এবার থামুন।