নারীকে বেত্রাঘাত-পাথর নিক্ষেপ: বর্বরতার বিচার হোক
এ সমাজের প্রায় সবাই নিজেদের একটু বেশিই ধোয়া তুলসি পাতা ভাবে। কিন্তু যারা ঠিক যতটা এই অতিরঞ্জিত পুত-পবিত্র ভাব ধরে, তাদের মধ্যেই গলদ বেশি; এটা হলফ করে বলা যায়। মূলত নিজেদের দোষ- ত্রুটি ঢাকতেই তারা অন্যের ওপর চড়াও হয়। আর এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে সেই নরম জায়গাটা হলো নারী। এ সমাজে যেকোনো নারীর ওপর অত্যাচার এতটা সহজ যে, সেখানে সবাই মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকেন। যে বা যারা নির্যাতনে শামিল হন বরং সেই দুষ্ট চক্রই আবার অন্যদের বাহবা পায়। এ সমাজের এই পচা-গলা-দুর্গন্ধযুক্ত মানসিকতা আমাদের দিনে দিনে আরও গ্রাস করছে।
কোথাও একটু ছেদ পেলেই বা কিঞ্চিৎ ত্রুটি পেলেই সেটাকে টেনেহিঁচড়ে আরও চতুর্গুণ করা এ জাতির স্বভাবে পরিণত হয়েছে। নারীর প্রতি এমন বিদ্বেষ শুধু পুরুষতান্ত্রিকতার খোলসে এঁটে নারীর পায়ে শেকল পরিয়ে দেওয়ার জন্য। শুধু নারী হয়ে জন্মবার অপরাধেই টেনেহিঁচড়ে শেয়াল-কুকুরের দল ভক্ষণ করতে ব্যস্ত সর্বদা। এই হায়েনারা কি জানেন না, এ সমাজে নারীরা হুঙ্কার ছাড়লে লেজ গুটিয়ে পালানোর পথ পাবে না এসব অপোগণ্ড। কারণ নারীদের আত্মত্যাগ- হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় টিকে আজও এ সমাজব্যবস্থা! তবু কেন এত নৃশংস হিংস্রতা নারীর প্রতি?
এ সমাজের নীতি-নির্ধারক কে? পরিবার, সমাজ নাকি ব্যক্তি নিজে? প্রকৃতার্থে মানুষ কোনো পশু নয় যে খাঁচায় আঁটকে তাকে পোষ মানানো যাবে। মানুষ মাত্রই স্বাধীনতাকামী। আর ‘স্বাধীনতা হীনতায়’ কেউই বাঁচতে চায় না, টিকে থাকতে পারে না। তাহলে কেনো এত হিংস্র দানবের নখরাঘাতে নারী বিধস্ত-বিব্রত সবিশেষ অত্যাচারিত? কোন সমাজে বাস করছে আজকের আধুনিক ধ্যান-জ্ঞান-যুক্তিবাদী মানুষ? নাকি সবটাই ভণ্ডামি! বিবেকের প্রশ্নে বেশিরভাগই নীরব। গলা শুকিয়ে যায়, চুপসে আসে চকচকে মুখগুলো। শুধু নোংরামিতে ঠাঁসা মস্তিষ্ক নিয়ে সর্বদা নারীর পায়ে বেড়ি পরানোর জন্য এ সমাজের একশ্রেণি সর্বদা উদগ্রীব। অলস মস্তিষ্ক, মোল্লাতন্ত্র, কুসংস্কার, অশিক্ষা, অজ্ঞতার জেরে নারীকে নিজেদর চালিত যন্ত্রমানব ভাবেন অধিকাংশ। তাইতো আজও এ সমাজে নারীকে বেত্রাঘাত করা হয়। পাথর নিক্ষেপ করা হয়। ধিক্কার এসব নরপিশাচদের প্রতি যারা বিচারের নামে এমন বর্বরোচিত কর্মে লিপ্ত হয়েছেন।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত কিছু ঘটনায় চোখ আটকে যায় বারবার, ভার হয়ে আসে চোখের পাতা। আর ঘৃণায় মিইয়ে যেতে ইচ্ছে হয় মাটির সঙ্গে! কোন সমাজে বাস করছি আমরা। কোথায় নিরাপদ নারী? জনসম্মুখে একজন নারীর ওপর অত্যাচার হয় আর আজও অধিকাংশ মানুষ সে তামাশা দেখতেই ব্যস্ত থাকেন। কারো মধ্যে নেই প্রতিবাদের ভাষা। বরং আছে অপরাধীকে সমর্থন করেই প্রশংসা বাণী।
৪ এপ্রিল রাতে চুনারুঘাটে এক নারীর ওপর ফতোয়া জারির সংবাদ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে জানা গেছে, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের অভিযোগ তুলে স্থানীয় সালিসে ওই নারীকে ৮২টি বেত্রাঘাত করা হয়েছে। এবং একইসঙ্গে তার ওপর ৮০টি পাথর নিক্ষেপ করা হয়েছে। এছাড়া সেই নারীকে এক মাস ঘরে অবরুদ্ধ থাকার আদেশও দেওয়া হয়। এবং সালিসকারীরা ঘোষণা দেন, সিদ্ধান্ত অমান্য করে ঘর থেকে বের হলে তাকে আরও ভয়াবহ শাস্তি দেওয়া হবে। বিবৃতিতে বলা হয়, চুনারুঘাটের ঘটনার সঙ্গে ২০১৭ সালে ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুরের এক ঘটনার মিল পাওয়া যায়। সেখানেও অনৈতিক সম্পর্কের অভিযোগ তুলে স্থানীয় সালিসে এক গৃহবধূকে দোররা মারার ঘটনা ঘটেছিল। ঘটনার পর ওই নারী আত্মহত্যা করেন। নারীর সঙ্গে এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা আজও এ সমাজের আনাচে – কানাচে অহরহ ঘটছে। তবু নীরব এ সমাজ- রাষ্ট্র!
চুনারুঘাটে নারীর সঙ্গে যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে তার তীব্র প্রতিবাদ জানাই। এই নারীর প্রতি যে অবিচার হয়েছে এবং যারা এই কাজে লিপ্ত ছিলেন তাদের চিহ্নিত করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। সমাজে নারীর প্রতি এমন হিংস্র মানসিকতাকে বাড়তে দিলে দিনে দিনে নারীদের প্রতি আরও রূঢ় হয়ে উঠবে পুরুষতন্ত্র। তাই বিবেক- বুদ্ধির কপাটাবদ্ধকে ভাঙতে হলে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। কঠোর হস্তে দমন করতে হবে এসব নির্যাতন। আর সমাজের কিছু কুসংস্কার, মোল্লাতন্ত্রঘেঁষা মানুষের এমন বিষ যাতে আর কাউকে দংশন করতে না পারে এজন্য এসব অপরাধকারীদের বিষ দাঁত উপড়ে ফেলে সমাজে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। নারী মানুষ হিসেবে বাঁচুক। স্বাধীন-সার্বভৌম দেশে নারী-পুরুষের চলাফেরা, কথাবার্তা, জীবনযাপনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী হোক মানুষ। কোনো আদিম গুহায় মানুষ আজ নেই। তাই এ ধরনের বর্বরোচিত-নৃশংস ঘটনার নিষ্পত্তি হওয়া জরুরি।