নারীর মনোবলই হোক পথের দিশারী
আমাদের পরিবার ও সমাজে কন্যাসন্তানকে এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যে, নারী হয়ে ওঠার আগেই তার মানসিক মৃত্যু ঘটে! সমাজে প্রচলিত একটি প্রবাদের জেরেই তাকে পিষ্ট করা হয়। ধ্বস্ত করা হয় মানসিক শক্তি। পরবর্তীকালে তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয় নানাবিধ বিধিনিষেধ। যা নারীকে বহন করতে হয় আজীবন।
সমাজে আজও প্রচলিত একটি প্রবাদেই নারীকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলা হয়। বলা হয়, নারী কুড়িতেই বুড়ি। কত ভয়াবহ এবং বিভৎস মানসিকতায় তলিয়েছে এ সমাজ! শুধু প্রবাদেই সীমাবদ্ধ নয় বরং কন্যা সন্তানের মননে এবং মগজে শৈশব থেকেই জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় এই মানসিকতা। যার ফলে একজন নারীর জীবন বলতেই বোঝানো হয় যেন এই কুড়ি বছর! এর বাইরে নারী যতদিন বাঁচে সেটুকু তার উপরি পাওনা! এবং খুব জোর করেই নারীদের মগজে বার্ধক্যের জরাজীর্ণতা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এর ফল যে কতটা ভয়াবহ নারী মাত্রই তা অনুধাবন করতে পারেন।
সমাজের প্রচলিত ধারণার ফলে অধিকাংশ নারীও বিশ্বাস করতে বাধ্য হন, কুড়ি পেরোলেই তার সৌন্দর্য, কর্ম শক্তি কমে আসবে৷ এ সম্পর্কে দ্বিধাহীন হয়ে পড়েন তাই অনেকেই! এই একটি ধারণা অধিকাংশ বাঙালি নারীকে শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রেখেছে আজও। কুড়ি পেরোলেই পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার এই আঁচ নারীকে হতাশায় ডুবিয়ে দেয়। সবচেয়ে বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হয় তার সৌন্দর্য!
সমাজের দিকে দৃষ্টি দিলেই এর ভয়বহতা লক্ষ করা যায়। আজও এত বাল্যবিয়ের পিছনে সক্রিয় একটি কারণ এটি। বেশিরভাগ পরিবারই মনে করেন, কন্যা সন্তানের বয়স কুড়ি পেরুলে তার জন্য ভালো পাত্র মেলা ভার। পরিবারের এমন বিশ্বাস করার পেছনেও এই সমাজের মানসিকতাই দায়ী। কারণ অধিকাংশ পাত্রপক্ষই নারীর বাহ্যিক সৌন্দর্যের প্রতি মুগ্ধ। নারী কতটা সুন্দর তার পরিমাপ করা হয় বয়স এবং দৈহিক সৌন্দর্যে! ফলে পরিবার-পরিজনও সমাজিক এই রীতি-নীতিকে মেনে কন্যা সন্তানকে অল্প বয়সেই পাত্রস্থ করার চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েন। মেয়ে কতটা সুশিক্ষায় শিক্ষিত হলো, স্বাবলম্বী হলো কিনা সে দেখার ভার এ সমাজের নেই। আর যদি কেউ কুড়ি পেরুলোও বিয়ের পীড়িতে না বসে তাহলে এ সমাজের তীর্যক মন্তব্য তাকে ক্ষত-বিক্ষত করতেও দ্বিধা করে না।
পরিবার- সমাজের এমন কিছু আরোপিত নিয়ম-নীতির ফাঁদে পড়ে নারীরা আজও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। নিজেদের শিক্ষা, স্বাবলম্বী হওয়ার প্রতি যতটা না মনোযোগী হয়ে উঠছেন তার চেয়ে বেশি বিব্রত হচ্ছেন কুড়ি পেরুলেও কেনো তারা বিয়ের পীড়িতে বসছেন না!
এখন তথ্য-প্রযুক্তি- জ্ঞান – বিজ্ঞানের যুগ। আর এর বদৌলতে সম্প্রতি মানুষ বিশ্বজুড়ে এক পরিমণ্ডলে ঢুকে পড়েছে। খুব সহজেই চলছে তথ্যের আদান-প্রদান। আর সহজ হয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থাও। কিন্তু মানুষের মধ্যেকার হীন মানসিকতা এখনও উগ্র। যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে জীবন পরিচালনা করার চেয়ে তারা প্রচলিত নিয়ম-নীতিকেই আঁকড়ে বসে আছে। আর সব বাধা- বিপত্তি নারীকে ঘিরে।
পৃথিবীময় নারীরা যেভাবে নিজেদের মেলে ধরছেন বাঙালি নারীরা ঠিক ততটা আজও এগুতে পারেনি। এর কারণ নারীর মনোবল। নারীকে কুড়িতেই বুড়ি করে দেওয়া হচ্ছে। তাদের সামনে যে আরও অসংখ্য সময়, অনেক কিছু জানার-বোঝার এবং করার আছে সেটাই ভাবতে দেওয়া হয় না। মূলত বলা হয় কুড়ি পেরুলে ভালো পাত্র পাবে না, সংসার হবে না, বিয়ে -বাচ্চা কোনোটাই মিলবে না। ফলে নারীরা তখন নিজের মধ্যেই হতাশায় ডুবে যেতে থাকে। সামনের দিকে যতটা এগুতে যায় ঠিক ততটাই পিছিয়ে পড়ে সমাজের এমন পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার কাছে! ফলে নারীদের যদি জাগতে হয় তবে মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। পরিবার-সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে নারীর বয়স কোনো বিষয় নয়। নারীর মনোবলই সব।
বিশ্বের দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পাওয়া যায়, যে বয়সে একজন নারী সংসার জীবনে প্রবেশ করছে, বাঙালি একজন নারী সে বয়সে ছেলে বা মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় তৎপর। তাদের কোন স্কুল-কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালে ভালো হবে, তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে নানাপ্রকার ভাবনায় ঘুরপাক খায়। স্বামী- সন্তানের দিয়ে তার পরিপার্শ্ব ভরে থাকে। আর সে নিজের জীবন সম্পর্কে থাকে অজ্ঞ। কিন্তু একটু মানসিকতার পরিবর্তন করলেই বিষয়গুলো খুবই সুশৃঙ্খলভাবে একজন নারীর জীবনে আসতে পারে। সমাজের এসব প্রচলিত ধারণাকে টপকিয়ে যদি নারীরা মনোবল ঠিক রেখে সামনের দিকে এগুতে থাকে তবে বিজয় সুনিশ্চিত। নারীরা শুধু জীবন বিসর্জন দিয়ে নয় বরং নিজের জীবনকে যেমন সাজাতে সক্ষম হবে তেমনি পরিবার-পরিজন নিয়েও সুখে থাকতে সক্ষম হবে। এর জন্য প্রয়োজন নারীর মানসিক শক্তি। ধৈর্য আর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয়। তাই নারীকেই ঠিক করতে হবে তিনি সমাজের পচা-গলা নিয়ম-নীতির কাছে হার মানবেন নাকি মানসিক শক্তিকে দৃঢ় করে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাবেন!