১১৫ বাল্যবিয়ে ঠেকানো প্রিয়াংকা: মানবকল্যাণের অগ্রদূত
বাল্যবিয়ে, নিঃসন্দেহে একটি সামাজিক ব্যাধি। গ্রামাঞ্চলে বাল্যবিয়ের অবস্থা এখনো ভয়াবহ। অনেকেই সোচ্চার হয়েছেন এই সামাজিক ব্যাধির বিরুদ্ধে। প্রিয়াংকা হালদার তাদেরই একজন। ২০১৩ সালে এক সহপাঠীর বিয়ে আটকানো দিয়ে শুরু হয় তার এই যুদ্ধ। এখন পর্যন্ত ঠেকিয়েছেন ১১৫ বাল্যবিয়ে। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, যেখানে বাল্যবিয়ে, সেখানেই প্রিয়াংকা হালদার।
আমাদের দেশে বিয়ের জন্য মেয়েদের ১৮ বছর আর ছেলেদের ২১ বছর বয়স নির্ধারণ করা হয়েছে। নির্ধারিত এই বয়সের আগে বিয়ে মানেই বাল্যবিয়ে। সরকারি ও বেসরকারি নানা উপায়ে বাল্যবিবাহের কুফল দেখিয়ে দেওয়া হচ্ছে চোখে আঙুল দিয়ে। কিন্তু লাভ হচ্ছে না। নির্মূল হচ্ছে না বাল্যবিয়ে।
গ্রামাঞ্চলে এখনো স্কুলপড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। ছেলের বয়স কোনো বিষয় না বাবা মায়ের কাছে। ছেলে উচ্চবংশীয় আর ভালো টাকা-পয়সার মালিক হলেই হলো। পাত্রের বয়স ৫০ হোক বা ৬০, তা দেখার বিষয় না। অনেক সময় সচেতন কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে মেয়ের বাবা-মা দেখায় নানা অজুহাত। পাড়ার বখাটে ছেলের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে পাত্রস্থ করছেন মেয়েকে অথবা গরিবের ঘরে মেয়েটি সংসারের বোঝা। তাই একটু ভালো টাকা-পয়সা আছে বা প্রবাসী, এমন ছেলে পেলে রাজি হয়ে যান মেয়ের বাবা-মা।
আমাদের সমাজে একজন দরিদ্র মানুষের ঘরে কন্যাসন্তান জন্মানো মানেই পরিবারের কর্তার মাথায় পাহাড় সমান বোঝা। চিন্তায় তার জীবন অন্ধকার। মেয়ে ১০ বছর পার করলেই তাকে পাত্রস্থ করার ভূত মাথায় চেপে বসে। কিন্তু অপরিণত একটি মেয়েকে সংসারের এই গুরুদায়িত্ব তুলে দেওয়া কতটা যৌক্তিক, তা ভাবার সময় পান না অবিভাবকরা। পুতুল খেলার বয়সে একটি মেয়ের বুঝতে হয় সংসারের লীলাখেলা। মেয়ের ভালো করতে গিয়ে বাবা-মা খারাপটাই বয়ে আনছেন না তো?
অন্যের ঘরে গিয়ে স্বামী-সংসার সামাল দেওয়ার মতো জ্ঞান ১১-১২ বছর বয়সী একটি মেয়ের থাকে না। এই বয়সে তার ডানা মেলে ওড়ার কথা, দুনিয়ার রঙিন জিনিস দেখার কথা, স্বপ্ন বোনার কথা, বই-খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা। এই বয়সে কেন তাকে সংসারের মায়ায় জোর করে বাঁধতে হবে? কেন তাকে সংসার নামের এই খুঁটির সঙ্গে বেঁধে রাখতে হবে? মেয়েকে কেন বাবা-মায়ের অভিলাষের বলি বানাতে হবে?
অল্প বয়সে মেয়ের বিয়েতে যেসব খরচ হবে, পাত্রদের যত টাকা যৌতুক দিতে হবে সেগুলো দিয়ে মেয়েটির পড়ালেখার খরচ জোগান। এই মেয়েটিই বড় হয়ে নিজের পায়ে নিজে দাঁড়াবে। নিজের দায়িত্ব নেবে। বাল্যবিয়ে রোধে এগিয়ে আসতে হবে আমাদেরকেই। যেমনটা এসেছেন প্রিয়াংকা।
প্রিয়াংকার এই কাজ নিঃসন্দেহে প্রশংসার। নারীদের উন্নয়ন ও জাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। বর্তমানে নারীদের বিচরণ সর্বত্র। নারীরা নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে শিখছে। কিন্তু বাল্যবিয়ে নারীদের অবদমিত করার একটি অন্যতম প্রয়াস। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে নারীকে অবদমিত করার উপায় বাল্যবিয়ে। বাল্যবিয়ের কারণে নষ্ট হয় অনেক কিশোরীর স্বপ্ন, বাধাগ্রস্ত হয় নারী উন্নয়ন, অকালে ঝরে যায় অনেক কিশোরীর প্রাণ।
নারীদের উন্নয়নের অন্যতম উপায় শিক্ষা। শিক্ষার অধিকার প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার। নারীকে তাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করে অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়া মানে তার মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করা। নারীকে ঘরবন্দি করা। নারীকে শুধু স্বামী-সংসারের মধ্যেই আবদ্ধ করা। নারীকে বাইরের জগৎ থেকে দূরে রেখে তাকে একটি সীমারেখা টেনে দেওয়া।
নারীর অধিকার আদায়ের প্রথম ধাপ শিক্ষার অধিকার। পুরুষের বেঁধে দেওয়া বেড়ি থেকে বের হতে হলে প্রতিটি নারীকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হবে। আর এজন্যই বন্ধ করতে হবে বাল্যবিয়ে। আর এক্ষেত্রে যথার্থ কাজটিই করেছেন প্রিয়াংকা। বাল্যবিয়ে বন্ধে তার এই উদ্যোগের জন্যই অনেক মেয়ে পেয়েছে নতুন জীবন। ফিরে পেয়েছে হারিয়ে যাওয়া আশার আলো। তাই শুধু প্রিয়াংকাকে নয়, এই কঠিন সামাজিক ব্যাধি দূর করতে এগিয়ে আসতে হবে প্রিয়াংকার মতো আমাদের সবাইকে। তবেই কেবল সম্ভব হবে চিরতরে বাল্যবিয়ে নির্মূল। নারীরা অর্জন করতে পারবে যথাযোগ্য মর্যাদা। পুরুষের পাশাপাশি প্রতিটি নারী অবদান রাখবে দেশ ও দশের উন্নয়নে।