স্বামীর নাম মুখে নিতে আজো নারীর বাধা কেন
প্রতিটি স্তরেই নারীর হাত-পা আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা। অর্থাৎ ঘরের দুয়ার থেকে শুরু করে মৃত্যুাবধি সর্বক্ষেত্রে নারী তার আপন জগৎকে সাজাতে পারে না। যুগের ধারাবাহিকতায় আজকালকার নারীদের চিন্তাধারা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হলেও অধিকাংশই রয়ে গেছে গাঢ় অন্ধকারে। সেই অন্ধকার ভেদ করে এসব পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতাসম্পন্ন মানুষের বেরিয়ে আসা আজও সম্ভব হয়নি। যুক্তি-বুদ্ধি সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে শুধু আবহমানকাল ধরে চলে আসা কুসংস্কার বা প্রথা নামক অপপ্রথাকে প্রশ্রয় দিয়ে এসেছে। বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তির যুগ হলেও একশ্রেণির মানুষের মস্তিষ্কের বিকার ভেদ করে তার আলো পৌঁছায়নি। ফলে কারো কোনো ক্ষতির সম্ভবনা না থাকলেও শুধু কিছু কুক্ষিগত অপপ্রথার ধারক-বাহক এসব শ্রেণী!
আধুনিক মানুষের বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে যুক্তি-বুদ্ধিকে সঙ্গী করে জীবনের পথে চলা। যেখানে লাভ বা অলাভের কোনো প্রশ্নই থাকে না সেখানে নিজের স্বাচ্ছন্দ্যকেই মানুষ প্রাধান্য দেয় বেশি। তবু কিছু কিছু বিষয়ে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা আজও সদর্পে বিদ্যমান। যেমন স্বামীকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে বর্তমান সময়ে এসে অনেক নারীই স্বামীর নাম উচ্চরণ করে থাকেন। কিন্তু আমাদের সমাজ আজও এই সাধারণ এবং সাদামাটা বিষয়টিকে খুবই তীর্যক চোখে দেখে থাকেন। এমনকি আজও বেশিরভাগ নারীই স্বামীকে ডাকার ক্ষেত্রে বা সম্বোধনের প্রয়োজন হলে খুব ইতস্তত করেন। কিভাবে স্বামীর নাম উচ্চারণ করবেন তার মুখ দিয়ে! কিন্তু আজকার যুগে এসে ভেবে দেখা দরকার একটি মানুষের নামকরণ করা হয় কেন? আর স্বামীর নাম উচ্চারণ করলে কী হয়? প্রথম প্রশ্নের উত্তর এটাই যে, প্রত্যেক ব্যক্তির নামকরণ করা হয় তাকে চিহ্নিত করার স্বার্থে। আর দশটা মানুষের মধ্যে সহজেই যাতে নিজ পরিচয়ে পরিচিত হন সেলক্ষেই নামের প্রয়োজন। এর বেশি কিছুই নয়।
অন্যদিকে নাম রাখাই হয় সম্বোধনের জন্য। একজন ব্যক্তিকে অনেকের মধ্যে নির্দিষ্ট করতেই নামের প্রয়োজন কিন্তু এই নামকে কেন্দ্র করেও আমাদের সমাজে কিছু অপপ্রথার চালু হয়েছে প্রচীনকাল থেকেই। এখনো সমাজের অনেক নারীরা স্বামীর নাম মুখে আনাকে পাপ বলে গণ্য করেন। এমনও অনেক গল্প লোকমুখে প্রচলিত যে, স্বামীর নাম রহমান হওয়ায় স্ত্রী যখন নামাজ পড়তে বসেন এবং যেস্থানে রহমান শব্দটি আছে সেখানে তিনি খোকার বাপ-খুকির বাপ এ ধরনের যুক্তিহীন কথাকে প্রাধান্য দেন। আবার এমনও দেখা গেছে কারো স্বামীর নাম পটল সেক্ষেত্রে তিনি যখন সব্জি রান্না করছেন তখন তিনি এটাকে ফল বলে পরিচয় দিচ্ছেন। এরকম হাজারো উদাহরণ দাঁড় করানো যাবে। সবই যে কথিত এমনটি নয় এ সমাজে এরকম উদাহরণ বহু। কিন্তু আসলেই এর উপযুক্ত কারণ দেখাতে পারবে কী এই শ্রেণি!
জীবন চলে যুক্তির দৌঁড়ে। কিন্তু আমাদের সমাজের বেশিরভাগ মানুষই যুক্তিকে ভয় পান। কারণ তাদের ধারণা যুক্তিতর্কে এসে যদি তিনি পাপের ভাগী হন। ফলে এই পাপ-পুণ্য নামক হিসেবে এসে তারা যেখানে কোনোরকম ক্ষতি বা লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা নেই সেখানেও থমকে দাঁড়ায়। এককথায় বলা চলে, চিন্তাকেই প্রাধান্য দেন না। সবাই যে পথে চলেছে সেই পথ ধরেই হাঁটতে অভ্যস্ত। আমাদের সমাজে চলে আসা এই অপপ্রথার কোনোই ভিত্তি নেই। তবু যুগের চাহিদা, মানুষের জীবনমানের পরিবর্তন ফলে কেউ যদি নামকে গুরুত্ব দেন সেক্ষেত্রে তাকে পরিবার-পরিজনের তোপের মুখে পড়তে হয়। এমনকি শ্বশুর-শাশুড়ি বা আত্মীয়-স্বজনের খুব কটাক্ষের শিকার হতে হয়। তবে স্বামীর নাম ধরে ডাকা বা সম্বোধনের ক্ষেত্রে তার নাম বলার মধ্যে আদৌ কোনো কী খারাপ কিছু হওয়ার সম্ভাবনা আছে? বিবেকবান মানুষ মাত্রই জানেন এটা খুবই অবান্তর প্রশ্ন।
বহির্বিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যাবে তারা স্যার বা ম্যাম বলার মধ্যেও অসম্মানবোধ করেন। তারা একে অপরকে সম্বোধনের ক্ষেত্রে নিজেদের নামকে প্রাধান্য দেন। যেটা আমাদের সমাজে অকল্পনীয়। স্টুডেন্ট, শিক্ষক থেকে শুরু সব শ্রেণির মানুষই নিজেদের পরিচয়কে গুরুত্ব দিতে ভালোবাসেন। তবে আমাদের সমাজে উল্টো চাষ কিন্তু চলেই আসছে। স্বামী নির্দ্বিধায় স্ত্রীর নামে ডাকতে পারবেন। কিন্তু স্ত্রী পারবেন না। তবে হ্যাঁ এটি কোনো বৈধ আইন করে নয় বরং অলিখিত সংবিধানের মতোই এ সমাজের পুরুষতান্ত্রিক শ্রেণি মান্য করেন। এসব বর্বর অপপ্রথা সমাজ থেকে চিরতরে দূর করা প্রয়োজন। কারণ ছোট ছোট বৈষম্য বা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বীজ থেকেই সমাজে মহীরুহ তৈরি হয়। তাই ছোটখাটো ডালপালা ছেঁটে ফেলা জরুরি। যুক্তিহীন জীবনকে আধুনিক মানুষ কখনোই গ্রহণ করতে পারেন না। ফলে সময়ের সঙ্গে মানুষকে পরিবর্তন হতে হবে। ধ্যান-জ্ঞান-জীবনযাপনের ধারা পরিবর্তন করতে হবে। যা প্রয়োজন সে অনুযায়ী পথ চলতে হবে। শুধু লক্ষ রাখা প্রয়োজন কেউ ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে কিনা। যদি অপরের ক্ষতি না হয় তবে স্বাচ্ছন্দ্যকে প্রাধান্য দেওয়া প্রয়োজন। আর সমাজের নারীরাও বাধার মুখে পড়ে যুক্তিহীন জীবনযাপন করা থেকে বিরত থাকুক। সভ্য-সুন্দর জীবনকে সাদরে আমন্ত্রণ জানাক নারী।