আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কবিতায় লোকজ-ঐতিহ্যে ও নারীর জীবন
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ (৮ ফ্রেবুয়ারি ১৯৩৪-১৯ মার্চ ২০০১) বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী। কিংবদন্তির কবি ছিলেন তিনি। লোকজীবনের হৃদয়ছোঁয়া সাবলীল কথকতা তুলে ধরেছেন শৈল্পিক সৃষ্টিতে। অসমান্য সৌন্দর্যতৃষ্ণা, লোকজ ঐতিহ্য, রুচিস্নিগ্ধ মনন, তীক্ষ্ণ গভীর সাহিত্যবোধের দ্বারা বাংলা কবিতার জগৎকে আলোকিত করেছেন। নিজস্ব, অননুকরণীয় কাব্যভাষা তাঁর সহজাত। ফলে বাংলা কবিতাকে তিনি নিপুণ শৈলীতে নান্দনিকতায় সুরভিত সুষমা দান করেছেন৷ সহজ- সরল এবং নিরাভরণযুক্ত কাব্যভাষার মাধ্যমে জীবন জিজ্ঞাসায় ব্যাপৃত হয়েছেন। তাঁর সাতনরী হার (১৯৫৫), আমি কিংবদন্তির কথা বলছি ( ১৯৮১), বৃষ্টি ও সাহসী পুরুষের জন্য প্রার্থনা( ১৯৮৩), খাঁচার ভিতর অচিন পাখি, মসৃণ কৃষ্ণ গোলাপ, কমলের চোখ, কখনও রং কখনও সুর, সহিষ্ণু প্রতীক্ষা, আমার সময় প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ’র এসব কাব্যগ্রন্থের প্রধান অনুষঙ্গ লোকজ ঐতিহ্য। তবে কবি লোকজ ঐতিহ্যের অনুসন্ধান করতে গিয়ে নারীকে প্রধানত উপাদান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই নারীর জীবনচারিত্র্য উল্লেখিত হয়েছে। যেখানে আবহমান নারী তার রূপ, জীবন, প্রকৃতি, মায়াময় ছোঁয়ায় আবিষ্ট করেছে পাঠককে। আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ এক আত্মানুসন্ধানী সাধনামগ্ন লেখক। তাঁর কবিতা নদীর স্রোতের স্বচ্ছন্দে প্রবাহমান। মন্ত্রমুগ্ধ করে তোলে পাঠকের হৃদয়। ফলে আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলা কবিতায় নতুন প্রাণের সঞ্চার করেছেন।
তাঁর কুচবরণ কন্যা বাংলার আবহমান নারী। এই নারী মায়াময় পৃথিবীর নির্মাণ করে চলেছে ভালোবাসা দিয়ে। যে নারী কৃষ্ণবর্ণের হলেও তার মেঘবরণ চুলে পাগল করেছে প্রিয়তমকে। ভালোবাসায় আবিষ্ট করেছে অতি আপনজনাকে। একইসঙ্গে মায়া-মমতায় ঋদ্ধ করেছে পৃথিবীর চিরন্তন মাতৃকাকে। প্রিয়তমার গলায় যে পুরুষ সাতনরী হার পরিয়ে দিতে চায়। সে যখন তা পায় না তখন গলার ফাঁসিই তার কাছে শ্রেয় হয়ে ওঠে। কবি লোকজ ঐতিহ্য ব্যবহার করে
নারীর রূপতৃষ্ণা প্রেমিককে মোহিত করে সেদিকেই ইঙ্গিত দিয়েছেন । আবহমানকাল ধরেই নারী তার রূপে বিকোয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর রূপই যে নারীকে কদর করার মাধ্যম সেদিকও পরিস্ফুট হয়ে এ কবিতায়। কবির কবিতায় বিষয়টির অবতারণা করা হয়েছে এভাবে –
কুঁচবরণ কন্যা তোমার
মেঘবরণ চুল,
চুলগুলো সব ঝরেই গেল
গুঁজব কোথা ফুল।
……………….……
নাই- বা পেলাম পৃথিবীতে
ফুলশয্যার রাত
কবরেতে জড়িয়ে নেব
তোমার চুলে হাত।
কবি আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ বাংলার চিরায়ত রীতির অনুসন্ধান করেছেন। নারীর সৌন্দর্য লুকায়িত তার চুলে। সেই চুলেই যখন প্রেমিকের মনোবাসনা পূরণ না হয় তখন পরলোকেই তাকে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। তবে কবি তাঁর কবিতায় লোকজ প্রসঙ্গের অবতারণা করে আবহমান নারী জীবনের
রূপায়ণ করেছেন। যে নারী কল্প প্রেয়সী। মনের বাসনায় লালিত প্রতিটি প্রেমিকের। রূপকথার মায়াপুরীতে যে নারী আজও দিবানিশি যাতনা দেয় প্রেমিক পুরুষের হৃদয়ে। তাঁর ‘সাতনরী হার’ কবিতায় তাইতো কবি বলেছেন যদি প্রেয়সীকে সাতনরী হার না-ই দিতে পারেন তবে গলায় দড়িই শ্রেয়।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রূপকথার ফেরীআলা। তাইতো তাঁর কবিতায় রূপকথার মায়াবী রূপায়ণ ঘটেছে। আর এই নবরূপয়ণে নারীও নতুন সাজে সজ্জিত। বিয়ের বরণে নারীর মনোমুগ্ধকর সাজ পুরুষের হৃদয়ভার সৃষ্টি করে। গভীর যাতনা নবরূপে সজ্জিত নারীকে বুকে পাওয়ার। আর এই নারীর গায়ের রূপের ঢল প্রেমিক পুরুষের কামনায় আরও মাধুর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিয়ের কনের আবহমান সাজে সজ্জিত করার সেই রীতিই এখানে নবরূপে ফুটে উঠেছে। কবি বলেছেন –
কন্যে তোমার গায়ে- হলুদ
তত্ত্ব এনেছি।
পোড়া চোখের কালি দিয়ে
কাজল এঁকেছি।
আলতো পায়ে আলতা দেব
হৃদয় ছিঁড়েছি
খোঁপায় দেব বুকের কাঁটা
কণ্ঠে দপব কী?
কণ্ঠে দেব গজোমতি
পাঁজর ভেঙেছি
কন্যে তোমার গায়ে- হলুদ
তত্ত্ব এনেছি।
রূপকথার গজমোতি হার কন্যের কণ্ঠে পরিয়ে দিয়ে কবি নারীকে বরণ করে নিতে চান। রূপকথার গল্পে যে নারী প্রতিটি শিশু হৃদয়ে বিরাজ করতো আজ সে কল্পলোকের রাণী হারাতে বসেছে। কালের ক্ষেয়ায় তাইতো কবি আবারও সেই রাণীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন নতুন আঙ্গিকে।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ লোকজ ঐতিহ্যকে নতুন করে তুলে এনেছেন কবিতায়। যার দ্বারা তাঁর কবিতা হয়ে উঠেছে লোকজ শিল্প-সংস্কৃতির শ্রেষ্ঠ রূপ। বর্তমান সময়ে এসে লোকজ ঐতিহ্য সংগৃহীত হচ্ছে। কিন্তু কিছুকাল পূর্বেও বাংলার আবহমান ঐতিহ্যগুলো অনাদরে অবহেলায় হারিয়েছে। কিন্তু সেই হারানো খনির সন্ধানে ব্যাপৃত হয়ে সেগুলো চিরযৌবন দান করেছেন কবি। সেই দানেই কবিতার ভাষার সহজ- সরল রূপ প্রতিটি প্রাণকে ছন্দোময় করে তোলে। অষ্টাদশ শতকের বর্গির ভয়াবহ আক্রমণ আজও ইতিহাসের পাতায় অক্ষত। একসময় বাংলার মায়েরা সন্তানের ঘুম পাড়ানির গানে যুক্ত করেছিল এই বর্গীর আক্রমণের ঘটনা। যেই ঘটনা যুক্ত করে সন্তানের মনে ভয় সৃষ্টি করতো। আর মায়ের ছন্দের তালে ভয়ের বলে কোলের শিশু চুপটি করে ঘুমিয়ে যেত। নারীর সেই সুরারোপিত ছন্দ মাধুর্য বাণী উঠে এসেছে কবির কবিতায়। কবি বলেন-
বর্গিরা তো আর আসে না
খুকুর ঘুমের উপায় কী?
বন্যা এসে ধান ফুরাল
তবু তো ঘর জুড়ায়নি।
ভাগ্য ভালো তুফান এল
নইলে পরে বুলবুলি
ধান না পেয়ে চাল- চুলোতে
হাত বাড়াত নিশ্চয়ই।
একটু কেবল বিপত্তি
গাছতলাতে ঘুম পাড়াতে
খুকুর মায়ের আপত্তি।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ কবিতায় আত্মমগ্ন থেকেছেন তবে সেই মগ্নতায় তিনি স্থান দিয়েছেন নিজ শিল্প- সংস্কৃতিকে। হারিয়ে যেতে বসা লোকজ ঐতিহ্য তাঁর রচনায় এত চমকপ্রদ হয়ে উঠেছে যে, কালের আবহে তিনি অম্লান থেকে যাবেন। তাঁর কবিতায় নারীর চিরন্তন লোকজ রূপ প্রকাশিত হয়েছে। যে নারী রূপে-গুনে স্বরস্বতী সেই নারীই মানুষের কাম্য তবে কবির কবিতায় নারীর স্থান মায়াময়। কঠোরতা তাকে স্পর্শ করেনি। ফলে নারী প্রাণের চিরন্তন সত্তাই তাঁর কাম্য। তাই ইতিহাস, কিংবদন্তি, ঐতিহ্যের ভাস্বরে প্রাণ পেয়েছে তাঁর নারীপ্রাণ।