ডিভোর্স হলেই নারীকে বিরূপ মন্তব্য নয়
মানুষ সামাজিক জীব। ফলে সমাজবদ্ধ জীবনযাপন করতে গিয়ে নারী-পুরুষকে সংঘবদ্ধভাবে বাস করতে হয়। আর এই বসবাসের ক্ষেত্রে সামাজিক রীতিনীতি মেনে নারী-পুরুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়। যার মাধ্যমে দুজন মানুষ একে অন্যের জীবনসঙ্গী হওয়ার সামাজিক স্বীকৃতি লাভ করে৷ তবে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ফলে স্বামী-স্ত্রী একে অন্যের প্রতি অনেক বিষয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। একইসঙ্গে জীবনাচরণেও পরিবর্তন ঘটে। সেক্ষেত্রে দুজন ব্যক্তির আচার-আচরণ যতই ভিন্ন হোক না কেন, স্বামী-স্ত্রী হওয়ার খাতিরে তাদের দুজনকেই কিছুটা ছাড় দিয়ে বা মানিয়ে নিতে হয়।
তবে আমাদের সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকেই মেনে নিয়ে, মানিয়ে নিয়ে জীবন পরিচালনার শিক্ষা দেওয়া হয়। এমনকি বেড়ে ওঠা পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করে এসে নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে নারীকে ন্যূনতম সহযোগিতাও করেন না অধিক স্বামী। এর ফলে সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন পরিবেশে নারীকে ঠিক সীতার অগ্নিপরীক্ষাটাই দিতে হয়। যদিও নারীর জন্য এই পরীক্ষা চলে আমৃত্যু!
যুগের চাহিদায় নারী-পুরুষ উভয়ের তালিকায় যোগ হয়েছে নতুন নতুন কিছু স্বপ্ন-কল্পনার। যখন নারী-পুরুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন এই কল্পলোকের চাহিদাগুলোকে পূরণে মরিয়া হয় কেউ কেউ। ফলে পুরুষ বা নারীর ক্ষেত্রে যখন তার চাহিদার সঙ্গে যোগান মেলে না তখনই সাংসারিক জটিলতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো ডিভোর্স। আর প্রতিটি ডিভোর্সের নেপথ্যে থাকে হাজারটা কারণ। যেগুলো কেউ ফোকাস করতে চায় কেউবা নিজের আত্মসম্মান রক্ষায় এড়িয়ে যায়।
আমাদের সমাজে আজ অবধি ডিভোর্সের শিকার নারী এবং পুরুষের গড় করলে এটাই দেখা যায় যে, এ সমাজে নারীরা সর্বাধিক কটূক্তি, হেনস্তা ও নির্যাতনের শিকার ডিভোর্সকে কেন্দ্র করে। একজন পুরুষ যত সহজে নিজের ত্যক্ত-বিরক্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আবারও সুন্দর করে জীবন সাজিয়ে-গুছিয়ে নিতে সক্ষম হয়, নারীর ক্ষেত্রে আজও সম্ভবপর হয়নি! এর কারণ আমাদের সমাজের পুরুষতান্ত্রিক নোংরা এবং হীন-মানসিকতা।
বিবাহবিচ্ছেদ বা সম্পর্কচ্ছেদের পেছনে কিছু জটিল সমস্যা থাকে। যার গভীরতা চারপাশের মানুষ আঁচ করার ক্ষমতাও রাখে না। স্বামী-স্ত্রী যখন একছাদের নিচে বাস করার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তাদের মধ্যে ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধ-সম্মান খুবই জরুরি হয়ে পড়ে। বলা চলে, এই তিনটি না থাকলে তাকে সম্পর্কই বলা যায় না। কিন্তু যারা আজ পর্যন্ত ডিভোর্সের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের সবার মধ্যেই এর ব্যাপক ঘাটতি পরিলক্ষিত হয়েছে। তবু অধিকাংশ মানুষ সম্পর্কের তীর্যকতা এবং রূঢ়তা উপেক্ষা করেও সংসারকে টিকিয়ে রাখতে চান। কারণ সমাজ-সংসার-অভ্যস্ততা এমনকি কোনো একপক্ষের ভালোবাসাও বটে! তবে যখন পুরুষ বা নারী এই সুযোগটুকুও হারান তখনই কেবল তিনি বা তারা আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
এত যাতনার পরে যেই নারী বা পুরুষ একটু ভালো থাকার আশায় সংসার নামক যন্ত্রণা থেকে বেরিয়ে আসে তবু তার ভাগ্যে সুখ বা শান্তির দেখা মিলছে না। এক্ষেত্রেও নারীই ভুক্তভোগী বেশি। তার কারণ আমাদের সমাজের নোংরা মানসিকতা। অন্য ব্যক্তির ব্যক্তিগত বিষয়কে মজার খোরাক ভেবে বা তাকে ছোট করে এক ধরনের বিকৃত ক্ষুধা নিবারণের নিমিত্তে তার বেঁচে থাকাকে হারাম করে দেয় একশ্রেণির নিম্ন রুচির মানুষ । নানারকম কটু মন্তব্যে ভরিয়ে তোলে পরিপার্শ্ব। ফলে নারীর জীবন অতিষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু প্রতিটি মানুষেরই অন্যের ব্যক্তিগত জীবনে নাকগলানো উচিত নয়। তারওপর সবচেয়ে বড় কথা হলো, বাইরে থেকে অন্যের ঘাঁ কতটুকুই বা উপলব্ধি করা যায়! যে বা যিনি সেই জীবন যাপন করছেন তিনিই তো তার ভালোটা অর্থাৎ মানিসক শান্তি বুঝবেন। ফলে শুধু মনগড়া কিছু মন্তব্যে ডিভোর্সী নারীর জীবনকে অতিষ্ট না করা উচিত। বরং পাশে থাকতে না পারলেও অন্তত এ সমাজ থেকে বিরূপ মন্তব্যগুলো বিদায় করা উচিত।
এ লক্ষ্যে প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে নারীদেরই। যতই বলি না কেন আমরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বসবাস করি তবে এ সমাজে পুরুষতন্ত্রের ধরন সবচেয়ে বেশি বহন করে চলেছে কিছু নারীই! যারা অন্যের ব্যক্তিগত জীবনকে অবসরের খোরাক ভাবেন। কোনকিছু বাছবিচার না করেই নিজে নারী হয়েও অন্য নারীকে খোঁচা দিতে পিছপা হন না। ফলে এ সমাজে যতদিন এমন হীন মানসিকতার পরিবর্তন না ঘটবে ততদিন নারী সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ পাবে না।
তাই আগে নারীকে পাল্টাতে হবে। স্বজাতির প্রতি নমনীয় হতে হবে। ডিভোর্স সবসময় নেতিবাচক নয় এটাও বুঝতে হবে। কারণ যে পরিমানে হত্যা, আত্মহত্যা বেড়েছে সেখানে অধিকাংশের নেপথ্যে রয়েছে দাম্পত্য সংকট। একটি জীবনের মূল্য অনেক। সেটা অন্যের কাছে না থাকতেই পারে। কারণ যে বা যারা আঘাত পাচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে তার জীবন তার কাছেই গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তিনি অর্থাৎ সেই ব্যক্তিরই অধিকার তিনি নিজের জীবনকে কিভাবে দেখতে চান। তাই না জেনে না বুঝে বিরূপ মন্তব্য করা বন্ধ করুন। সমাজের বদ্ধমূল সংস্কার থেকে বেরিয়ে আসুন। যুগ পাল্টেছে। মানুষের মূল্যবোধ ও আত্মসম্মানও বেড়েছে। ফলে অন্তত মানুষ হিসেবে নিজের মূল্যবোধ বৃদ্ধি করুন।