সরস্বতীরা ঝরে না পড়ুক
হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব সরস্বতী পূজা আজ। শাস্ত্রমতে, প্রতিবছর মাঘ মাসের শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে শ্বেতশুভ্রা কল্যাণময়ী বিদ্যাদেবী সরস্বতীর আরাধনা করা হয়। জ্ঞান ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতী ভক্তদের মানবীয় চেতনায় উদ্দীপ্ত করেন। ভক্তকুল সরস্বতী পূজা নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন করছে ঠিকই আবার অন্যদিকে দেশে সরস্বতীদের ঝরে পরার হারও বেশি।
টানা দু’বছর করোনার অভিঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা খাতে বড় কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ঝরে পড়ছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীরা। কভিড-১৯ সংক্রমণকালে ও পরবর্তী সময়ে শিখন ঘাটতি মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নেয় সরকার। তবে বাল্যবিয়ের শিকার ও শ্রমঘন কাজে জড়িয়ে পড়া শিশুদের বিদ্যালয়ে ফেরাতে ছিল না সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম। ফলে ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে বিদ্যালয়গুলোতে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানের তথ্য বিশ্লেষণ করে এই চিত্র মিলেছে। এতে দেখা গেছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের প্রায় সাড়ে ৯ লাখ শিশু আর বিদ্যালয়েই আসছে না। তাদের প্রায় সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান, যার অর্ধেকই আবার কন্যাশিশু। করোনাকালে পরিবারের আয় কমে যাওয়ায় অভিভাবকরা অনেকটা বাধ্য হয়েই তাদের শ্রমঘন কাজে সংযুক্ত করেছেন। আর কন্যাশিশুদের বড় একটা অংশেরই বাল্যবিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)এর করা জরিপের তথ্য বলছে, করোনা মহামারির মধ্যে ২০২১ সালে দেশের অর্ধেকের বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ৪ লাখ ৮১ হাজার শিক্ষার্থী বার্ষিক পরীক্ষায় অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে ৪৭ হাজারের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান মাউশি বলছে, কেবল ২০২১ সালে মাধ্যমিকের ৪৭ হাজার ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়ে গেছে। তাদের তথ্যমতে, গত ডিসেম্বরে ২০২১ সালের বার্ষিক পরীক্ষায় পৌনে পাঁচ লাখের বেশি শিক্ষার্থী অনুপস্থিত ছিল। তাদের মধ্যে শিশুশ্রমে যুক্ত ৭৮ হাজার। দেশের ২০ হাজার ২৯৪ বিদ্যালয়ের মধ্যে ১১ হাজার ৬৭৯টির তথ্য পেয়েছে মাউশি।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের ‘কন্যাশিশু পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন-২০২২’-এর তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত দেশের ২৮টি জেলায় ২ হাজার ৩০১ জন কন্যাশিশু বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে। সে হিসাবে প্রতি মাসে ২৮৮ জন কন্যাশিশুর বাল্যবিয়ে এবং একই সময়ে ৫৮৯টি প্রতিরোধ করা হয়েছে। বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, করোনাকালে দেশে গড়ে প্রতিদিন ৬৫টি করে বাল্যবিয়ে হয়েছে। সাত মাসে ২১ জেলার ৮৪ উপজেলায় মোট ১৩ হাজার ৮৮৬টি বাল্যবিয়ের তথ্য পেয়েছে তারা।
বাল্যবিবাহ, কন্যাসন্তানের শিক্ষায় জোর না দেয়া আমাদের দেশে যেন নিয়মিত ব্যাপার। দেশ অনেক আধুনিক হয়েছে। শিক্ষাক্ষেত্রে নারীর অগ্রগতি, প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অবদান চোখে পরার মত। একইসঙ্গে চোখে পরার মত এই জরিপগুলোও, যেখানে দেখা যায় মারাত্মক হারে ঝরে পরে নারী শিক্ষার্থীরা। এখনো দেশের অনেক পরিবার নারী শিক্ষাকে বিলাসিতাই মনে করেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিকে নারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা চোখে পরার মতো হলেও আরও উচ্চ শিক্ষা নেয়ার আগে অনেক নারী শিক্ষার্থীই ঝরে যায়।
ঝরে যাওয়া সেই শিক্ষার্থীরা হতে পারতো নাম করা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার আরও কত কি। কিন্তু লক্ষ্মী সাজার ঘোরে এসব সরস্বতীরা নিজেদের বিসর্জন দিয়ে দেন। কোনো নারী নিজেকে প্রমাণ করতে চাইলে সমাজ হাজারটা উপায় বের করে তাকে থামানোর জন্য। বারবার স্মরণ করিয়ে দেয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বানানো কিছু নিয়মের কথা। নারী বেশি পড়াশোনা করতে চাইলে বলা হয়, মেয়েদের আবার এতো লেখাপড়া কিসের সেই তো বিয়ে করে রান্নাই করবে। মেয়েদের শিক্ষণীয় বিষয় বলে ধরা হয়, রান্নাবান্না আর মানিয়ে নেয়া।
সমাজকে এগিয়ে নিতে নারী-পুরুষ উভয়ের ভূমিকাই জরুরী। আর সমাজের উন্নয়নে নারী তখনই ভূমিকা রাখতে পারবে যখন তাকে স্বাধীনতা দেয়া হবে, শিক্ষার সুযোগ দেয়া হবে। যদিও আমাদের সমাজে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা যে ঘাঁটি গেড়ে বসে আছে তা এতো সহজে উপরে ফেলা সম্ভব নয়। তবে দেবীর আরাধনার পাশাপাশি সবার চিন্তাধারায়ও বদল আনা দরকার, যাতে এভাবে সরস্বতীরা অহরহ ঝরে না পারে।