সন্তানের অভিভাবক মা: পথ দেখালো হাইকোর্টের স্বীকৃতি
অনেক জল্পনা-কল্পনা শেষে আজকে সুদিনের মুখ দেখলো পিতৃপরিচয়হীন সন্তান। ফলে আজকে আনন্দের দিন সেই সন্তানদের যারা পিতার পরিচয় থেকে বঞ্চিত বা পিতৃপরিচয় দিতে অস্বীকৃতি জানায়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাসিন্দা আমরা। ফলে স্বাভাবই নারীর অস্তিত্বকে ম্লান করে দেখে এই সমাজ। কিন্তু একটু ভেবে দেখলেই সত্যিটা বড় ভয়াবহ। যেই নারী সন্তানকে গর্ভে লালন-পালন করে একসময় পৃথিবীর আলো দেখান সেই মাকেই পরবর্তীকালে তুচ্ছ করা হয়। মা আর সন্তানের অভিভাবকত্ব পান না। আজব সংস্কার বা প্রথার চর্চায় বিশ্বাসী ছিল এ সমাজ। তবে আশার আলো দেখা গেলো আজ। সেই আশার আলো জ্বালাতে সাহায্য করছেন কিছু সংগঠন। আর সেটাকে বৈধরূপে আইনে পরিণত করলেন হাইকোর্ট। আর হাইকোর্টের এ রায় সমাজে নতুন দিক উন্মোচন করবে।
মানুষ যেহেতু সমাজবদ্ধ জীব ফলে তার একটা পরিচয় দেওয়া হয়, তবে এই পরিচয় হওয়া উচিত গৌণ। কারণ মানুষের পরিচয় তার নিজের গড়ে তোলা। তার কর্মগুণে হওয়াই উচিত। ফলে পিতৃ-মাতৃ পরিচয়কে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিতে গিয়ে সমাজে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। তবে এই পরিচয় ব্যক্তির স্বাধীনতা অনুযায়ী হওয়া উচিত। তাহলে সমাজে অনেক অন্যায় নিমেষেই কমে যাবে। মা বা বাবা একজন উভয় পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আবার কেউ মাকে নয় বাবাকে গুরুত্ব দেন। তার পরিচয়কে সামনে আনতে চান। আবার কেউ চান বাবা নয় বরং মা তার গার্জিয়ান। ফলে ব্যক্তির পরিচয়ের ক্ষেত্রে কোন একটি নির্দিষ্ট না করে বরং বাবা-মা দুই অপশনের যে যেটাকে দেখাতে চান, সেটাই গৃহীত হওয়া উচিত। আবার যারা বাবা-মা উভয়কেই তাদের অভিভাবকের জায়গায় রাখতে চান তাদের জন্য সে ব্যবস্থাই করা উচিত।
বিষয়টি অনেক গভীরের। আজকাল দেখা যায় রাস্তায় নবজাতক পড়ে আছে। কারণ নারীরা পিতৃপরিচয় সামনে আনতে চান না। বা সমাজের কটুকথা শুনতে চান না। এক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় এই নারীকে। এর বাইরে বেরিয়ে আরও একটি বিষয় বিশেষভাবে জ্ঞাতব্য যে, এই সন্তানদের অধিকাংশ পথশিশু, এতিম হয়ে বড় হয়। ফলে মানুষ হিসেবে গড়ে না উঠে অধিকাংশক্ষেত্রে তারা অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। ফলে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা পরিবর্তন করলে অনেকটা সামাজিক অপরাধগুলো কমে আসবে আশা করি।
শুধু এই ঘটনায় নয় বরং সামজিকভাবে প্রচণ্ডভাবে আমরা অস্থিতিশীল সময়ে বাস করছি। যান্ত্রিক যুগে পরিবারের বন্ধন দৃঢ় না হয়ে বরং শিথিল হয়ে পড়েছে। সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটছে খুব বেশি। তবে এর মাঝে ট্রমার সৃষ্টি হচ্ছে সন্তানেরক্ষেত্রে৷ দেখা যায় দেশের প্রচলিত নিয়মানুযায়ী মায়ের কাছেই সন্তানেরা থাকছে বেশিরভাগসময়। সেক্ষেত্রে বাবার নাম অনেকেই ব্যবহার করতে চান না। ফলে স্কুল, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে অর্থাৎ সারাটা জীবন এই নারীর সন্তান তার বাবার নাম সামনে আনছে৷ ফলে বিবাহবিচ্ছেদ ঘটার পরও মূলত নারীকে তার পূর্বের ‘ঘা’কে জিইয়ে রাখতে হচ্ছে সন্তানের মুখ চেয়ে। তাই হাইকোর্টের এই রায় সুদিনের গান শোনায়। জীবনকে নতুনরূপে সাজানোর পথের প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সহায়ক। শিক্ষার ক্ষেত্রে সন্তানের অভিভাবক হিসেবে মাকে স্বীকৃতি দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট, মঙ্গলবার (২৪ জানুয়ারি) বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি মো.খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। যাদের অক্লান্ত পরিশ্রম বা যাদের মাধ্যমে জাতি সুদিনের পথ দেখলো তাদের সবাইকে সাদুবাদ জানাই।