মানসিক ভারসাম্যহীন নারীর কোলে মৃত সন্তান: এই দায় রাষ্ট্রের
কয়েকদিন যাবৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একটি সরগরম খবরে বারবার চোখ আটকে যাচ্ছে! ঘটনাটি বেশ বিরল। একজন মানসিক ভারসম্যহীন নারীর সন্তান জন্মদান এবং পরবর্তীকালে কোথাও ঠাঁই না পেয়ে সন্তানের মৃত্যু। এ পর্যন্ত হয়তো ঘটনাটি বেশ স্বাভাবিক। তবে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে উঠেছে, যখন এই মানসিক ভারসম্যহীন মা চারদিন পর্যন্ত রাস্তায় ঘুরেছেন তার কোলের শিশুটি যেন জীবিত হয়ে যায়। ঘটনাটি ঘটেছে রংপুর শহরে। রংপুর নগরীর জাহাজ কোম্পানী মোড়ে রাজা রামমোহন মার্কেটের সামনে, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে পাতলা একটি কম্বল গায়ে জড়িয়ে এদিক-সেদিক ঘুরছেন এক নারী। কোলে ঘুমিয়ে নবজাত সন্তান। তবে চিরঘুমে নবজাতকটি।
তাকে দেখে কৌতূহলী পথচলতি অনেকেই কোলের সন্তান সম্পর্কে জানতে চান। কিছু মানুষের ভিড়ও জমে যায়। এরই মধ্যে ছুটে আসেন স্থানীয় কাউন্সিলর। আসে থানা পুলিশও। এমন ঠাণ্ডায় বাইরে অবস্থানের কারণ জানতে চাইতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই নারী। নাড়িছেঁড়া সন্তানটিকে বাঁচাতেই মানসিক ভারসম্যহীন মায়ের এত আকুতি। কবিরাজের স্মরণাপন্ন হতেও তিনি দ্বিধা করেননি তবে সাক্ষাৎ পাননি তার।
পুলিশ জানিয়েছে, ওই নারী রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার মধুপুর এলাকার বাসিন্দা। বিয়ে না হলেও এক অ্যাম্বুলেন্স চালকের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল। গত মাসের শেষের দিকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ এলাকায় সন্তান জন্ম দেন তিনি।
এরপর সন্তানকে নিয়ে তার নিজ বাড়িতে চলে যান। কিন্তু সৎ বাবা তাকে মারধর করেন ও শিশুটিকে বিক্রি করে দিতে বলেন। নির্যাতন সইতে না পেরে বাড়ি ছেড়ে রংপুর শহরে চলে আসেন এই নারী। গণমাধ্যম বরাত পাওয়া ঘটনাটির পর্যালোচনায় কয়েকটি বিষয় সামনে উঠে আসে।
প্রথমত, যে বিষয়টি বিশেষভাবে নাড়া দিচ্ছে মানসিক ভারসম্যহীন হলেও মা, মা-ই।
দ্বিতীয়ত, মানসিক ভারসম্যহীন নারীর সন্তান প্রসব তথা নাম-পরিচয়হীন শিশুর জন্ম।
তৃতীয়ত, নারীর প্রতি অত্যাচার, অমানবিক আচরণ।
বর্তমান যান্ত্রিক যুগে পরিবারের মধ্যে এতটাই অস্থিতিশীলতা, ভালোবাসা, সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে পড়েছে যে, বাবা- মায়ের কাছেও সন্তান নিরাপদ নয়। মাঝে মধ্যেই শোনা যায়, মা বা বাবার হাতে সন্তান খুন। ঘটনার পেছনের কারণ যাইহোক না কেন সন্তান বাবা-মায়ের কাছেও আজকে নিরাপদ নয়! দাম্পত্য কলহের জেরের বলি হচ্ছে সন্তান, কখনো কখনো বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জেরে সন্তানকে হত্যার ঘটনাও শোনা যাচ্ছে। এখন কথা হলো, নিজের অজান্তেই মানসিক ভারসম্যহীন মা তাদের জন্য প্রেরণার বার্তা দিয়েছেন। সন্তানকে কিভাবে আগলে রাখতে হয়। তার জন্য মায়ের উৎকণ্ঠা কতটা সবই প্রকাশিত হয়েছে। এত ঘটনার পরও আজ অবধি পৃথিবীতে একমাত্র মায়ের ভালোবাসকেই সবচেয়ে প্রাকৃতিক, বিশুদ্ধ জানা হয়। এই ঘটনাটি তারই প্রমাণ।
দ্বিতীয়ত, মানসিক ভারসম্যহীন একজন নারীকে কিভাবে গর্ভবতী হলেন? পুলিশ বলছেন, এক অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তার কোনোই হদিস নেই। আসলে কথাটি কী শুধু দায় এড়িয়ে যাওয়ার মাধ্যম? যদি সত্যিই বাচ্চাটি তার হয় তবে তাকে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। আর যদি তার না হয় তাহলে এই বিবেকহীন সমাজে নারীর অবস্থান কোথায়? একজন নারীকে বলা হচ্ছে মানসিক ভারসম্যহীন। তার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে পিছপা হচ্ছে না ভণ্ড, কাপুরষ! তাহলে স্বীকৃতিতে কেন অস্বীকৃতি! ফলে এই নারীর দায় কার? এ সমাজের। যারা তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি। যারা শুধু মানসিক ভারসাম্যহীন নারী বলে অপরাধকে প্রশ্রয় দিচ্ছে। নারীকে অত্যাচারিত হতে শেখাচ্ছে পরবর্তী প্রজন্মকে। ফলে সবকিছুর ঊর্ধ্বে উঠে এর সুষ্ঠু তদন্ত করে এই নারীর প্রাপ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়া হোক।
তৃতীয়ত, আমরা জানি, এ সমাজ কোনদিন নারীকে মানুষ মনে করে না। বরং নারী যেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ভোগের সামগ্রী তাইতো একজন মানসিক ভারসম্যহীন নারীকে ভোগ্যবস্তু করে তুলতেও দ্বিধা হয়নি! শুধু এই নারীই নয় এমন অসংখ্য ঘটনার সাক্ষী এ সমাজ আছে যারা পথশিশু বা পথেই যেই নারীদের ঘর-বসতি এই সমাজের কিছু নপুংসক দ্বারা তারা নির্যাতনের শিকার হয়। যা থেকে যায় অকথ্য। গহীন অন্ধকারে! কারণ এই হতভাগ্য চাল-চুলোহীন নারীদের হয়ে ন্যায্য কথা বলার লোকের বড়ই অভাব! আবার যারা বলতে চান বা কিয়দংশ বলেন তারাও কেন জানি নিজের স্বার্থসিদ্ধর হাতিয়ার করে তোলেন এগুলোকে! ফলে অন্তরালে থেকে যায় তাদের হাহাকার-শূন্যতা-কান্না। এসব নারীর প্রতি ন্যায়ের প্রতীকরূপে সুষ্ঠু সমাজ গড়ে উঠুক। যে সমাজ প্রত্যেক নারীর জীবন-সম্মান-সম্ভ্রমের নিশ্চয়তা বিধান করতে সক্ষম। আশায় দিনগুনি সেই শুভলগ্নের।