রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরেই
রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম হলো এমন একটি মানসিক ব্যাধি। যেখানে একজন ব্যক্তি নিজেদেরকে নিয়ে ভাববার বদলে অন্য কাউকে নিয়ে বেশী চিন্তা করে। মানে অন্য এক ব্যক্তির দায়িত্ব নিজের মনে করে। এবং রেসকিউয়ার সিন্ড্রোমে আক্রান্ত মানুষের নিজের শান্তি বলে কিছুই থাকে না। এরা সবসময় অন্যের সুখ নিশ্চিত করার কথা চিন্তা করে। যার জন্য সে এতকিছু করে সে যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার কখনো নাও করে, তবুও।
বাংলাদেশের নারী চরিত্রে এই বিষয়টি দেখা যায় প্রবলভাবে। একটা উদাহরণ দিলে আরো ভালো মত বোঝা যাবে রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম কি? শেমলেস নামের একটা টিভি সিরিজ আছে। সেখানে একটি চরিত্রের নাম হলো ফিয়োনা। ফিয়োনার চরিত্রটা একটু ব্যখ্যা করলে বোঝা যেতে পারে রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম জিনিসটি আসলে কি। ২০ বছরের একটি মেয়ে ফিয়োনা। তার ইউনিভার্সিটিতে পড়ার কথা থাকলেও সে ইউনিভার্সিটিতে যায় না। ঘরে বসে থাকে তার ছোটো ভাই বোন এবং বাবা মায়ের দেখাশোনা করে। এমনকি বন্ধুবান্ধব বলতেও দু একজন এবং যাদের সাথে সে হঠাৎই দেখা করে। দেখে মনে হয় সে তার সমস্ত জীবন সমর্পণ করে বসে আছে তার পরিবারের জন্য।
ফিয়োনার কাজ হচ্ছে তার ছোটো ভাইবোনদের দেখাশোনা করা এবং তার নেশাগ্রস্ত বাবার সমস্ত রকম অন্যায় অবিচার সহ্য করা। যদিও সবাই চেষ্টা করে সাহায্য করার কিন্তু তবুও ফিয়োনা যেহেতু সবার চেয়ে বড় তাই সমস্ত দায়দায়িত্ব সে নিজের ঘাড়েই নিয়ে নিয়েছে। এই বিষয়টি যদিও এসেছে ফিয়োনার বাবামায়ের প্রচণ্ড রকম অদায়িত্বশীলতা থেকে। তারা নিজেদের সমস্যা নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে নিজেদের সন্তানকে পর্যাপ্ত সময় দেয়ার কাজটি তারা করতে পারেননি। তাই ফিয়োনাকেই তার নেশাগ্রস্ত বাবা মায়ের জন্য পরিবর্তে মা বাবা উভয়ের দায়িত্বই নিতে হয়েছে।
রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম অনেকটা এমনই। তারা অন্যের সমস্যা গুলো নিয়ে পরে থাকে নিজেরটা বাদ দিয়ে। নিজের সমস্যা গুলো নিয়ে তারা এতটা গুরুত্ব দেয় না। এমনকি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নিজের স্বপ্ন, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং সমস্তটাই জলে ফেলে দেয় এরা। কারণ নিজেকে তারা তেমন গুরুত্বপূর্ণ মনেই করেনা।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম এর সাথে অনেকটাই মিল খুঁজে পাওয়া যায়। একজন নারী যখন সংসার জীবনে প্রবেশ করে, তখন নারীরা সব সময় পরিবারের সুখের জন্য নিজের সমস্ত স্বপ্ন, ক্যারিয়ার এবং স্বাচ্ছন্দ্যবোধ জলাঞ্জলি দিয়ে দেয়। অনেক অনেক কানাঘুষা আর অকৃতজ্ঞতা নিয়েও তারা সংসারটা ধরে রাখে৷ এমন না যে সব নারীদের তাই করা বাধ্যতামূলক, কিন্তু অন্যের প্রতি যে দায়িত্বটা নারীরা নিজের কাঁধে তুলে নেয়, সেই দায়িত্ব থেকে বের হতে হতে মৃত্যু চলে আসে।
কিন্তু এই যে রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম এই সিন্ড্রোমটা কি প্রতি ঘরে ঘরেই দেখা যাচ্ছে না? নারীদের ছোটো থেকে বড় হওয়ার যে ধরণ। এই ধরণটাই হলো একটা রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোমে আক্রান্ত রোগী হিসেবে গড়ে তোলার মত। অনেকেই বলতে পারে, রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম তো আর মরণ-ব্যাধি না। হাজার হাজার বছর ধরে নারীরা এভাবেই চলে আসছে এবং এই সকল নিয়মকানুন নারীর জীবনের কোনো ক্ষতি তো করছে না বরং তারা সুখীই৷ কারণ যে সন্তান এবং পরিবারের জন্য তারা আত্মত্যাগ করে তারা তো বৃদ্ধ বয়সে তার সেবা যত্ন করেই আসছে।
মূলত,এই চিন্তা হচ্ছে একটি কাঠামোগত ত্রুটির ফলাফল। আমরা ভাবতেই পারিনা যে একটা মানুষ ক্যারিয়ারের প্রতি এম্বিশাস না হওয়াটা যে একটি গুরুতর সমস্যা। ক্যারিয়ারের প্রতি এম্বিশন যদি যা থাকে তাহলে সমাজে সে একজন বোঝা। তাকে অন্য একজন মানুষের উপর নির্ভরশীল থাকতে হবে সবকিছুতেই।
এই অর্থনৈতিক দ্বায়গ্রস্থতা থাকে বলেই নারীরা আজও পরাধীন। অর্থনৈতিক ভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার মন মানসিকতা না থাকলে কখনোই নারীর মুক্তি হওয়া সম্ভব না। রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোমের যে ফাঁদে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে ঘরে বিদ্যমান আছে হোক সেটা স্বেচ্ছায় কিংবা চাপানো, এই রেস্কিউয়ার সিন্ড্রোম থেকে বের হওয়া কখনোই সম্ভব হবে না।
অনন্যা/জেএজে