বিজ্ঞানী সেঁজুতি সাহা ও আমাদের নারীসমাজ
আমাদের সমাজের প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী, একজন নারীর কাজ অন্দরমহলে। অথবা কাজ করতে চাইলেও শিক্ষিকা, সরকারি চাকরি কিংবা নার্সিং পেশা বেছে নিতে হবে। এই প্রচলিত ধারণা ভেঙে নারীরা অবদান রেখেছে অন্যান্য সেবা খাতেও। ব্যাংক-বীমা, সেনাবাহিনী, পুলিশ কিংবা ক্রীড়াবিদ, সব জায়গায় রয়েছে নারী। কিন্তু এসবের পাশাপাশি একজন নারী হতে পারে বিজ্ঞানীও। প্রাচীন যুগ থেকেই সমাজের নানা বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নারীরা অবদান রেখেছেন বিজ্ঞানে। বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় নাম লিখিয়েছেন নিজেদের।
প্রথা ভেঙে একজন নারী যে বিশ্বজয় করতে পারে তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মাদাম কুরি। নিজের মেধাশক্তির জোরেই প্রথা ভেঙে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করেন তিনি। আবিষ্কার করেন থোরিয়াম ও ইউরেনিয়ামের তেজস্ক্রিয়তা। পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম নামে দুটি মৌলিক পদার্থও আবিষ্কার করেন তিনি। পদার্থবিদ্যায় অবদানের জন্য পেয়েছেন নোবেল পুরস্কারও।
বাংলাদেশের নারীরাও যে বিজ্ঞানখাতে এগিয়ে রয়েছে, এই কথা অনেকের কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে। কিন্তু এমনটাই করে দেখিয়েছেন সেঁজুতি সাহা। একজন অনুজীববিজ্ঞানী তিনি। কুসংস্কার ও প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নিজেকে নিয়ে গেছেন সফলতার শিখরে। ২০২০ সালের কোভিড মহামারিতে করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেন তিনি ও তার দল। প্রমান করেছেন যে, সুযোগ পেলে নারীরাও কাজ করতে পারে।
আমাদের সমাজ এখনো নারীদের এসব পেশায় যাওয়ার পক্ষে না। একজন নারী বিজ্ঞানী হবে, নতুন জিনিস আবিষ্কার করবে এসব যেন তারা মেনে নিতে পারে না। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বড় বাধা পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মান্ধতা, মৌলবাদ ইত্যাদি।
ধর্মের বিধি-বিধানের দোহাই দিয়ে দমিয়ে রাখা হয় নারীদের। কিছু মৌলবাদী মানুষ ধর্মের বিধানের নামে অবরুদ্ধ রাখে নারীদের। নারীদের অগ্রগতির অন্যতম বাধা এই ধর্মান্ধতা। নারীদের এই করা যাবে না, ওই করা যাবে না, এসব কুসংস্কার বহু বছর ধরে চলে আসছে। নারীদের এগিয়ে যাওয়ার পথে এটিও একটি বড় বাধা।
দরিদ্র পরিবারে সাধারণত এক মুঠো খাবার জোগাড় করাই কষ্টসাধ্য, সেখানে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর কথা ভাবাই পাপ। যদিও বা ছেলেদের পাঠানো হয় কিন্তু মেয়েরা সে সুযোগও পায় না। দরিদ্র পরিবারে মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে সংসারের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। আর তাই অনেক নারীর বড় হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়।
একজন নারীর উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার পথে সর্বপ্রথম বাধা আসে তার পরিবার থেকে। মেয়ে একা বাইরে যাবে বা অফিসের কাজ করবে, এই ব্যাপারে থাকে তাদের ঘোর আপত্তি। তাই মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণার প্রদীপ নিভে যায় এখানেই। আমাদের সমাজ এখনও প্রাচীন যুগের রীতিনীতি মেনে চলে। এখনও একজন নারীকে তারা মানুষ হিসেবে ভাবতে পারে না। তাদের কাছে নারীরা মেয়ে মানুষ। মানুষের সামনে ওই মেয়ে ট্যাগটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে নারীদের জন্য। কিন্তু সমাজের এই ঘোরপ্যাঁচের উর্ধ্বে গিয়ে স্বপ্ন পূরণ করতে হবে নারীকে।
নারীদের পিছিয়ে থাকার জন্য রাষ্ট্রও অনেকাংশে দায়ী। নারীর জন্য বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা প্রয়োজন। যেমন, চলাচলের নিরাপত্তা, কাজের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ইত্যাদি নিশ্চিত করা।
নারীদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগাতে হবে পরিবারকে। শুধু নারী হয়েছে বলেই তাকে ঘরকন্নার কাজ করতে হবে এমন কুসংস্কার থেকে বের হয়ে আসতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে নারীর নিজের অদম্য ইচ্ছায়, নিজের স্বপ্ন পূরণের লক্ষ্যে। নিজেকে গড়ে তুলতে হবে উদাহরণ হিসেবে। তাহলে দেশে আরও অনেক সেঁজুতি সাহার জন্ম হতে পারে। আর সেই সেঁজুতি সাহারা মানবজাতিকে উপহার দেবেন নবনব আবিষ্কার। বাঁচিয়ে তুলতে পারবেন মৃত্যুপথযাত্রীকেও।