সেরা দশ ক্রীড়াবিদ: নির্লজ্জ পুরুষতন্ত্র, উপেক্ষিত নারী
বাংলাদেশের মেয়েরাও যে ফুটবল পায়ে মাঠ কাঁপাতে পারেন, ক্রিকেট ব্যাট হাতে ছক্কা হাঁকাতে পারেন, ভারোত্তোলনে আন্তর্জাতিক আসরকে উল্লসিত করতে পারেন, টেনিসে যে গিনেস বুকে নাম ওঠাতে পারেন—বিষয়টি আজও পুরুষতন্ত্র যেন মেনে নিতে পারে না। তাই স্বাধীনতা পরবর্তী সেরা দশ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের তালিকায় নারীদের কোনো স্থানই দেওয়া হয়নি। দেশের ক্রীড়া সাংবাদিকদের সবচেয়ে প্রাচীন সংগঠন ‘বাংলাদেশ ক্রীড়া লেখক সমিতি’ ২৮ ডিসেম্বর সেরা দশ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের নাম ঘোষণা করেছে।
সেরাদের মধ্যে রয়েছেন—কাজী সালাউদ্দিন, মোশাররফ হোসেন খান, শাহ আলম, মোশাররফ হোসেন (বক্সিং), মোনেম মুন্না, নিয়াজ মোর্শেদ,আসিফ হোসেন খান, মাশরাফি বিন মর্তুজা, সিদ্দিকুর রহমান, সাকিব আল হাসান। অথচ ক্রীড়াঙ্গনে বিভিন্ন জয়ের সাক্ষী কোনো নারীর নাম নেই এই তালিকায়। ক্রীড়াঙ্গনে নারীদের অবদান যেন পুরুষতন্ত্রের ধারক-বারকরা স্বীকারই করতে চাননি।
তারা একটু খানি মাথা ঘামালেই দেখতে পেতেন, গিনেস বুকে নাম লেখানো বাংলাদেশি টেনিস তারকা জোবেরা রহমান লিনুকে। তিনি দেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত এক মুখ। টেবিল টেনিস দিয়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। ১৯৭৭ থেকে ২০০১ অব্দি ১৬ বার জাতীয় টেবিল টেনিস চ্যাম্পিয়ন লিনু। এই সাফল্যের পথ ধরে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস উঠে যায় তার নাম। ২০০২ সালের মে মাসে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসে নাম লেখান লিনু। শুধু টেবিল টেনিস নয়, সাইক্লিংয়েও বেশ দক্ষ লিনু। ১৯৭৮, ১৯৭৯, ১৯৮০ সালে জাতীয় সাইক্লিং-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন জোবেরা রহমান লিনু। এখন তো লেখালেখিতেও ব্যস্ত রেখেছেন নিজেকে। ইউনিসেফের শুভেচ্ছা দূত হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
ক্রীড়াঙ্গনে অবদান রয়েছে আরেক নারীর। বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার রানী হামিদ। পুরো নাম সৈয়দা জসিমুন্নেসা খাতুন, ডাক নাম রাণী। ১৯৮৩ সালে লন্ডনে ব্রিটিশ দাবা চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিনি। তার পথ ধরেই ১৯৮৫ সালে ফিদে আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার খেতাব পান রানী। ৩ বার ব্রিটিশ মহিলা দাবা প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজেকে নিয়ে যান অনন্য উচ্চতায়।
১৫ বার জাতীয় নারী দাবা চ্যাম্পিয়নশিপে চ্যাম্পিয়ন রানী হামিদ আলোর পথের যাত্রী। তার দেখানো পথ ধরেই এগিয়েছে দেশের নারীরাও পা রেখেছেন ক্রীড়াঙ্গনে। আর রানী হামিদ ৭৭ পেরিয়ে গেলেও এখন প্রাণবন্ত। মগ্ন আছেন দাবার বোর্ডে।
নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই জাতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। এই সত্য যত দ্রুত বুঝবো, তত দ্রুতই এই জাতির মঙ্গল। না হলে করুণ পরিণতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘৃণাই অপেক্ষা করছে পুরুষতন্ত্রের জন্য।
ক্রিকেট ব্যাট-বলেও নারী এগিয়ে রয়েছেন। ২০০৭ সালের জুলাইয়ে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর একটু একটু করে এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশের মেয়েরা। ২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর, নারী ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাছাইয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ৯ উইকেটে হারিয়ে একদিনের আন্তর্জাতিকের মর্যাদা পায় টাইগ্রেসরা।
নারীদের ক্রিকেটে সেরা সাফল্যটা এসেছে ২০১৮ সালে। সাকিব আল হাসান কিংবা মাশরাফি বিন মর্তুজারা যা পারেননি তাই করে দেখিয়েছেন সালমা খাতুন আর জাহানারা আলমরা। ২০১৮ সালে এশিয়া কাপ শিরোপা জেতে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দল। ফাইনালে ভারতকে ৩ উইকেটে হারিয়ে শিরোপা জেতে টাইগ্রেসরা। বছরের শেষটাতে এসে মেয়েরা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার টিকিটও নিশ্চিত করেছে।
ফুটবলেও এগিয়ে নারীরা। ২০২২ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জেতেন বাংলার মেয়েরা। ২০২২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর প্রতিযোগিতার ফাইনালে বাংলাদেশ ও নেপাল মুখোমুখি হয়। এতে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ফুটবল দল নেপালকে ৩-১ গোলের ব্যবধানে পরাজিত করে তাদের প্রথম শিরোপা অর্জন করে ও ২০২২ সাফ মহিলা চ্যাম্পিয়নশিপের চ্যাম্পিয়ন হয়। বাংলাদেশি খেলোয়াড় সাবিনা খাতুন টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় ও সবচেয়ে মূল্যবান খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতেন। এছাড়া সর্বাধিক ৮টি গোল করে তিনি শীর্ষ গোলদাতার পুরস্কারও জিতেন। বাংলাদেশের রূপনা চাকমা সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার জিতেন, তিনি এই টুর্নামেন্টে সর্বাধিক চারটি গোল বাঁচান।
এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে সোনা জিতে বাংলাদেশের মাবিয়া আক্তার পদক নেওয়ার সময় যখন দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীতের সুরে অঝোরধারায় কাঁদেন, তখন কোটি কোটি বাংলাদেশির চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ে।
মাহফুযা খাতুন শীলা—২০১০ দক্ষিণ এশীয় গেমসে তিনি ১০০ মিটার ও ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে দুটি রৌপ্য পদক জয় করেন। ২০১৬ দক্ষিণ এশীয় গেমসে তিনি একই ইভেন্ট ১০০ মিটার ও ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকে স্বর্ণ পদক জিতেন। তার ৫০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকের সময় ছিল ৩৪.৮৮ সেকেন্ড যা দক্ষিণ এশীয় গেমসের নতুন রেকর্ড।
এত অর্জনের পরেও সেরা ১০ ক্রীড়া ব্যক্তিত্বের তালিকায় কোনো নারীর নাম নেই কেন? গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস-এ যার নাম রয়েছে, তিনি কেন সেরা দশের তালিকায় নেই? কেন সেরার তালিকায় নেই বাংলাদেশের প্রথম নারী আন্তর্জাতিক দাবা মাস্টার রানী হামিদের নাম? সাফ গেমসে শিরোপাজয়ীদের নাম কেন থাকবে না? কেন থাকবে না ভারোত্তোলনে স্বর্ণ জিতে আসা বাংলাদেশের মাবিয়া আক্তারের নাম? কেন থাকবে না মাহফুজা খাতুন শীলার নাম? তবে কি এত অর্জনের পরেও তারা সেরা দশের তালিকায় থাকার যোগ্য নন? না কি নারীবিদ্বেষী পুরুষতন্ত্রের কেউ নারীর কোনো অর্জনই স্বীকার করতে চান না? আর কতভাবে ধামাচাপা দেওয়া হবে নারীর অর্জন?
ক্রীড়াঙ্গনে সাম্প্রতিক নারীর অর্জনকে বাদ দিলেও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন দাবাড়ু রাণী হামিদ কিংবা টেনিসে গিনেস বুকে নাম লেখানো জোবেরা রহমান লিনুর নাম বাদ দেওয়া কোনোভাবেই যুক্তিসঙ্গত হতে পারে না। এই দুই মহাতারকা নারী ক্রীড়াবিদকে বাদ দেওয়ার পেছনে রয়েছে পুরুষতন্ত্রের নির্লজ্জতা ও নারী কৃতিত্বকে অস্বীকার করার ঘৃণ্য মনোবাসনা। যত দিন আমরা জাতিগতভাবে যার যার প্রাপ্য সম্মান বুঝিয়ে দিতে না পারবো, ততদিন সামগ্রিক উন্নতি সোনার হরিণ হয়েই থাকবে। কারণ কোনো জাতিই তার কোনো খাতেই নারীকে বাদ দিয়ে কেবল পুরুষের কর্মের গুণেই উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছাতে পারে না। নারী ও পুরুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই জাতি তার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে। এই সত্য যত দ্রুত বুঝবো, তত দ্রুতই এই জাতির মঙ্গল। না হলে করুণ পরিণতি ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘৃণাই অপেক্ষা করছে পুরুষতন্ত্রের জন্য।