সামাজিক নেতৃত্বে এগিয়ে আসুক নারী
রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সমাজবিজ্ঞানী, শিক্ষক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী, সবাই বলেন, সমাজ এগিয়ে যাচ্ছে। এই এগিয়ে যাওয়া বলতে লোকে হয়তো অর্থনৈতিকভাবে এগিয়ে যাওয়াকে বোঝান তারা। কখনো বা শিক্ষার হার বৃদ্ধিকে বোঝান। তবে সম্প্রতি নারীশিক্ষার অগ্রগতিকেও কেউ-কেউ সমাজ এগিয়ে যাওয়ার সূচক হিসেবে দেখেন। এই দেখায় ও বোঝানোয় সমস্যা দেখি না। সমস্যা দেখি অন্য জায়গায়। নারী যখন শিক্ষা-দীক্ষায় পুরুষের সমানই এগিয়ে রয়েছে, সেখানে সামাজিক নেতৃত্বে নারীর অবস্থানকে পুরুষতন্ত্র সহ্য করতে পারে না।
সহ্য করতে না পারা বেশ কিছু মৌলিক কারণ রয়েছে। কারণ, পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় পরিবার চলে পুরুষের কর্তৃত্বে। পরিবারের ভালো-মন্দ সবই পুরুষের মর্জির ওপর নির্ভর করে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেখানে নারীর অভিমতের তোয়াক্কা করা হয় না। এই দৃশ্য পরিবারে যেমন, তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রেও। সর্বত্রই নারীর নেতৃত্বকে দেখা হয় বাঁকা চোখে। তার নেতৃত্বের পথে তৈরি করা হয় বাধা-বিপত্তি। এমনকি কোনো পারিবারিক-সামাজিক গুরুত্ব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে নারীর মতকে গ্রহণও করা হয় না।
অথচ কে না জানে, নারী-পুরুষ মেধা-মননে সমান। কিন্তু পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে সব সময় দুর্বল ভাবা হয়। এমনকি নারীর মগজেও সেই বিশ্বাস ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, নারী দুর্বল, সে নেতৃত্বের যোগ্য নয়। সামাজিকভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কখনোই নারীর সিদ্ধান্তের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয় না। একটি গ্রামে বা মহল্লায় কোনো ঘটনা ঘটলে সে ক্ষেত্রে মোল্লা-মাতবর বা সমাজের উচ্চ পর্যায়ের কোনো পুরুষ থাকে কিন্তু নারীকে এ ধরনের সামাজিক কার্যক্রমে দেখা যায় না।
এলাকার উন্নয়ন থেকে শুরু করে সর্বত্রই পুরুষদের কর্তৃত্ব লক্ষণীয়। এমনকি যেখানে প্রাথমিক স্কুল, কলেজগুলোতে স্থানীয় প্রতিনিধি ও ম্যানেজিং কমিটি গঠন করা হয়, সেখানেও নারীদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। নারীরা পরিবারের বাইরে গিয়ে এ ধরনের সামাজিক কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হলেও পুরুষতন্ত্রের জটাজালে নারীরা ঘরমুখো।
শহরাঞ্চলে নারীরা অনেকটা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হলেও গ্রামাঞ্চলে নারীরা এখনো ঘরবন্দি। বেশিরভাগ মানুষের চিন্তাধারারই এখনো কুসংস্কারাচ্ছন্ন, রক্ষণশীলতায় আচ্ছন্ন। ফলে নারীর নেতৃত্ব অনেকেই মেনে নিতে নারাজ। ফলস্বরূপ নারীরা সামাজিক কার্যক্রমে পিছিয়ে আছে।
পরিবারের বাবা-ভাই-স্বামীর ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করে নারীর শক্ত মেরুদণ্ড গঠন করা কষ্টসাধ্য। কারণ একজন ব্যক্তি তখনই সমস্যার মোকাবিলা করতে সক্ষম, যখন তিনি সমস্যার ভেতর জীবন যাপন করবেন। বাইরের থেকে বলে বোঝানোর চেয়ে নিজে ঠেকে-ঠকে শিখলে নারীর অভিজ্ঞতা বাড়বে। নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সর্বত্রই দেখা যায়, পরিবারের সদস্যরা নারীকে ছাপোষা জীবনযাপনে অভ্যস্ত করে তোলে। ফলে নারীও পরনির্ভরশীল হয়েই জীবন কাটিয়ে দেয়। কখনো বাবা-ভাইয়ের হাত ধরে, কখনো বা স্বামী-ছেলের হাত ধরে। এই চলাই তাকে পঙ্গু করে তোলে। নিজের সত্তাকে চিনতে বাধাগ্রস্ত করে। আর নারীর এমন জীবনযাপনের জন্য পরিবার-সমাজ যতটা দায়ী, নারী নিজেও ঠিক ততটাই দায়ী। কারণ ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয়। তাই শোচনীয় জীবনযাপন করে, আজীবন পুরুষের দাসত্ব করে নিজের মেধা-মননকে গলাটিপে হত্যা করার কোনোই মানে হয় না।
কেউ কাউকে জায়গা ছেড়ে দেয় না। আর নারীদের জন্য এ পথ আরও কঠিন। তাই নেতৃত্বের ভার গ্রহণ করতে হলে নারীকে অপরাজেয় হতে হবে। পুরুষতন্ত্রের তালে তাল মিলিয়ে যদি নারীকে সামাজিকভাবে হেনস্তা করা হয়, নারীর যোগ্য অধিকার তাকে না দেওয়া হয় এবং সর্বোপরি নারীকে নেতৃত্ব দানে সক্ষম করে তোলা না যায়, সেটা সমাজ ও রাষ্ট্রেরও দায়।
বর্তমানে রাজনীতির ময়দানে পুরুষের চেয়ে নারীর অংশগ্রহণ বেশি নয়। বরং নারীদের জন্য রাখা হয় সংরক্ষিত আসন। নারী তার যোগ্যতা ও দক্ষতা দিয়ে জায়গা করে নিতে সক্ষম হলেও তাকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিপর্যস্ত হতে হয়। অশিক্ষা, সংস্কৃতির অভাব সেইসঙ্গে সঠিক বোধের অভাব নারীকে যোগ্য আসনে অধিষ্ঠিত হতে দেয় না। সামাজিকভাবে নারীর নেতৃত্ব গ্রহণ করা হয় না। না পরিবারে, না সামাজিক কোনো রীতিনীতি বা কোনো শালিসি আসরে।
নারীর প্রতি সম্মান বোধের অভাবের ফলেই বর্তমান যুগে এসেও সামাজিকভাবে নেতৃত্বের জায়গায় তারা নেই। নারীকে বেড়ে উঠতে দেওয়া হয় না। নারীর মতকে গ্রহণ করা হয় না। তাই পুরুষতন্ত্রের জয়ডঙ্কার তলে চাপা পড়ে নারীর যোগ্যতা-দক্ষতা। সর্বোপরি নারীর সামাজিক নেতৃত্বও। পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থায় নারী হয়ে উঠেছে পণ্য! কিন্তু নারীর অবদমিত শক্তিকে জাগ্রত করে নারীর নেতৃত্ব খুব একটা চোখে পড়ে না।
ডিজিটালাইজেশনের যুগে সবকিছুর যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। নারীরা আগের চেয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশি অগ্রসর। স্বনির্ভরতা বাড়ছে। কিন্তু সামাজিকভাবে নেতৃত্বের অভাব আজও। নারীর মতকে গ্রহণ করা হয় না। এমনকি সামাজিক উন্নয়নেও নারী পিছিয়ে আছে। এখনই সময় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নারীকে সামাজিকভাবে নেতৃত্ব দানে সহযোগিতা করা। স্কুল কমিটি, কলেজ কমিটি, সামাজিক শালিস, সামাজিকভাবে বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামো নির্মাণকাজে নারীর পরামর্শ, সহযোগিতা গ্রহণ করা।
সমাজকে সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে, নারীকেও সামাজিক নেতৃত্ব দানের অধিকার দিতে হবে। তার নেতৃত্বকে স্বীকার করে নিতে হবে। তার নেতৃত্বকে নারী বলে বাঁকা চোখে দেখা যাবে না। এই বাঁকা চোখে দেখার চেতনার দাসত্ব থেকে সবাইকে বের হয়ে আসতে হবে। তবে মানবিক সমাজ গঠন সম্ভব হবে।