‘আমার জীবনে কালোই তো সব!’
শবনম শারমিন, পেশায় একজন ফটোসাংবাদিক। নিজের জায়গা থেকে বেশ সফলই ছিলেন তিনি। তার লেন্সবন্দি হয়েছে কত শত মানুষের জীবনের গল্প। কোনো কোনো গল্প মানুষকে আনন্দ দিয়েছে আবার কোনো গল্প দু’চোখ ভর্তি জল এনে দিয়েছে। তবে তিনি কি কখনো আঁচ করতে পেরেছিলেন, তার জীবনের গল্পের শেষটা এত করুণ হবে, এত মানুষকে কাঁদাবে?
এই শীতের হিমেল বাতাসে প্রায় পাঁচ-সাত দিন ধরে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে তার লাশ ঝুলছিল। এই কয়েকদিনে তাকে হন্যে হয়ে খোঁজার মতো কেউ ছিল না, কেউ খোঁজেনি। লাশটি অর্ধগলিত হয়ে গেলো। তীব্র দুর্গন্ধে চারদিকের মানুষ খোঁজ নিলো আসলে ভেতরে কী হয়েছে। পুলিশ দরজা ভাঙতেই সাক্ষী হলো এক মর্মান্তিক দৃশ্যের। এরপর, একের পর এক শিরোনাম, ‘এক নারী সাংবাদিকের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার’, ‘আত্মহত্যা করলেন সাংবাদিক শবনম শারমিন’ আরও কত কী!
কিন্তু শবনম শারমিন কি আত্মহত্যা করার মতো নারী ছিলেন? একসঙ্গে প্রায় একবছর কাজ করেছি। কত স্মৃতি, কত কথা মনে গেঁথে আছে। সব মিলিয়ে দুয়ে-দুয়ে চার যে হচ্ছে না! কোথাও দুয়ে-দুয়ে চার মিলে গেলেও মন মানছে শবনম এই পৃথিবীর কোথাও নেই, আর কখনো ফিরবেন না। শবনম ছিলেন একজন প্রতিবাদী নারী। রাস্তায় বুলিংয়ের তীব্র প্রতিবাদ করতে দেখেছি। সিএনজি চালকের অসদাচরণের বিরুদ্ধে যখন আওয়াজ উঁচু করে উঠলেন, হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। কী কঠোরভাবে কথা বলছেন, অন্যায়ের প্রতিবাদ করছেন, গলা একটুও কাঁপছে না। মনে মনে ভাবলাম, কী সুন্দর প্রতিবাদী নারী। সেই নারী কিনা প্রতিবাদ না করে রাগে-ক্ষোভে-কষ্টে আত্মহত্যা করে ফেললেন!
তার জীবনটা একদম চকচকে রঙিন কখনো দেখিনি। ফেসবুক প্রোফাইলে একটি কালো রঙের প্রোফাইল পিকচার, একটি কালো রঙের কভার পিকচার থাকতো। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও নিজের ইচ্ছে মতো অন্ধকার করে রাখতেন। পরনে প্রায় সবসময়ই থাকতো কালো পোশাক। কালো রঙের প্রতি তার ভিন্ন এক আকর্ষণ ছিল।
শবনমের সঙ্গে ফটোস্টোরি তৈরির কাজ করেছি একসঙ্গে। ফটোস্টোরির জন্য রাস্তায় রাস্তায় হাঁটতাম, গল্প খুঁজতাম। হাঁটতে হাঁটতে কত রাজ্যের গল্প করতাম। একদিন গরমে অনেক হাঁটার পরে ক্লান্ত হয়ে এসির হাওয়া খেতে একটি শোরুমে ঢুকলাম। তিনি রীতিমতো কালো টিশার্ট দেখা শুরু করলেন। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কালো আপনার একটু বেশিই পছন্দ, তাই না?’ আমাকে বিস্ময়েরও সুযোগ না দিয়েই বললেন, ‘একটু বেশিই মানে কী, কালোই শুধু পছন্দ। আমার জীবনে কালোই সব।’ তাই বুঝি সব অন্ধকারাচ্ছন্ন করে দিয়ে এভাবে চলে গেলেন শবনম?
আমরা নারীদের নিয়ে কাজ করতাম। নারীর সফলতাকে তুলে ধরতাম, নারীর বিরুদ্ধে হওয়া অন্যায়কে তুলে ধরতাম, নারীর অধিকার আদায় নিয়ে আওয়াজ তুলতাম। বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নারীদের ছবি তুলে, গল্প লিখে অনুপ্রাণিত হয়েছি একসঙ্গে। কখনো ছোট্ট দোকানে কাজ করা নারীদের নিয়ে, কখনো নিরপত্তা রক্ষায় দায়িত্বরত নারীদের নিয়ে, কখনো ট্রাফিক কন্ট্রোল করছেন সেই নারীদের নিয়ে, কখনো রোগা এক নারীর রিকশার প্যাডেল ঘোরানো নিয়ে। এদের নিয়ে গল্প করতাম, অনুপ্রাণিত হতাম, শিখতাম কিভাবে বেঁচে থাকতে হয়, লড়াই করতে হয়।
লড়াই করার প্রসঙ্গে আরও একটি কথা মনে পড়লো। শবনমকে কাজের বিষয়ে হাল ছাড়তে দেখিনি। একবার ছবি তোলার জন্য বড় একটি শপিং মল থেকে কোনোভাবেই অনুমতি দিচ্ছিল না। আমি ভেবেছিলাম আশহত হয়ে ফিরেই যাবো। কিন্তু তিনি হাল ছাড়লেন না। এদিক থেকে ওদিক ছুটলেন অনুমতির জন্য। আবারও দেখতে পেলাম তার প্রতিবাদী রূপ। বললেন, ‘কেন ছবি তুলতে পারবো না, অন্যায় তো করছি না, ছবি তুলছি শুধু।’ তার আওয়াজে কর্তৃপক্ষের টনক নড়লো। প্রায় দেড়ঘণ্টা অপেক্ষার পর ছবি তুলতে দিলো।
তবে তার এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র লড়াইয়ের স্মৃতি যত মনে পড়ছে, ততই মনে হচ্ছে, এই নারী নিজের মনের সঙ্গে, জীবনের সঙ্গে লড়াই করতে পারলেন না? না কি তার এই একরোখা মনোভাব তার ভেঙে যাওয়া মনকে আর ফিরে আসতে দেয়নি স্বাভাবিক অবস্থায়। আদৌও কি শবনম আত্মহত্যা করেছেন? একগাদা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। কোনোভাবেই তার আত্মহত্যার বিষয়টি মানা যাচ্ছে না। অনেক বিষয় সামনে আসছে, মামলা হয়েছে, তদন্ত হচ্ছে। এবার দাবি, সুষ্ঠু তদন্ত হোক, প্রকৃত দোষী শাস্তি পাক।
শবনমের সঙ্গে শেষবার দেখা হয়েছে একমাসও হয়নি। বরাবরের মতোই হাসিখুশি ছিলেন। কী সুন্দর হাসি দিয়ে বলেছিলেন, ‘আপু আবার দেখা হবে শিগগিরই!’ আর দেখা হলো না, কখনো হবেও না। পৃথিবী যে বড়ই নিষ্ঠুর। শবনম ওপারে ভালো থাকবেন, এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আপনার মনো নিঃসঙ্গভাবে যেন কাউকে সিলিংয়ে সাত দিন ধরে দুলতে না হয় সেই প্রার্থনা করবেন।