নারী মডেলকে বুলিং: এই অসম্মানের অবসান হোক
প্রত্যেক ব্যক্তি তার নিজস্ব স্বাধীনতা ও সত্তায় বিশ্বসী। তবে কোনো ব্যক্তির ওপর যখন বাড়তি চাপ সৃষ্টি করা হয় তাতে করে ভুক্তভোগী ক্ষতির সম্মুখীন হন। এই ক্ষতি শারীরিক ও মানসিক দু’ধরনেরই হতে পারে। তবে মানুষের শারীরিক গঠন, সৌন্দর্য বা ওজনজনিত কারণে যদি কোনো সমস্যা সৃষ্টি হয় তবে তা শুধু ব্যক্তিটিকে মানসিক চাপের মধ্যেই ফেলে না। বরং তাকে চরমতম অপমান এবং অবমাননা করা হয়।
মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। যা কখনোই কাম্য নয়। কারণ মানুষ মাত্রই স্বতন্ত্র। আর এই স্বাতন্ত্র্য ব্যক্তির জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা, দক্ষতা, শারীরিক গঠন-সৌন্দর্য ভিন্নতর হবে এটাই স্বভাবিক। তাই এই স্বাভাবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান এমনকি রাষ্ট্রের জন্যও অন্যায়। তবু এমনই একটা চরমতম অমানবিক, হিংস্র; একইসঙ্গে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে ব্রাজিলিয়ান নারী মডেল হুলিয়ানা নেহেমের সঙ্গে। অতিরিক্ত ওজনের কারণে তাকে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি।
গত মাসে পরিবার নিয়ে ছুটি কাটাতে লেবানন গিয়েছিলেন হুলিয়ানা। ছুটি কাটিয়ে বৈরুত থেকে দোহায় ফেরার পথে এ ঘটনা ঘটে। এক হাজার ডলার দিয়ে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইটের ইকোনমি ক্লাসের টিকিট কেটেছিলেন ৩৮ বছর বয়সী এই মডেল। বিমানে ওঠার সময় এক কর্মী তাকে থামিয়ে বলে, আপনাকে তিন হাজার ডলার ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কেটে ভ্রমণ করতে হবে। কেন না ফার্স্ট ক্লাসের সিট আপনার জন্য পারফেক্ট। তখন তাকে বিমানে উঠতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া মডেল হুলিয়ানাকে জানানো হয় ফার্স্ট ক্লাসের টিকিট কাটলেও ফেরত দেওয়া হবে না তার ইকোনমি ক্লাসের টিকিটের অর্থ। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রাজিলের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন তিনি। এরপর অন্য ফ্লাইটে করে ফেরেন। দেশে ফিরেই বিমান সংস্থাটির নামে ব্রাজিলের আদালতে মামলা করেন।
চলতি মাসের ২০ তারিখ সেই মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। এটি কোন তুচ্ছ ঘটনা নয়। বরং এই ঘটনার গভীরতা অনেক। একজন মানুষকে শুধু তার দৈহিক ওজনের জন্য বিমানে উঠতে দেওয়া হলো নয় এটা কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ হতে পারে না। আমরা জানি প্রত্যেক দেশের প্রধানতম নিয়ম হওয়া উচিত, সে দেশের নাগরিকের সমান অধিকার। তবে এই নিয়মের আওতায় পড়ে না অনেক রাষ্ট্র। যদি পড়তো তবে নারী-পুরুষের বিভেদ এবং নারীর অধিকার নিয়ে এত কথা হতো না। এখন কথা হলো, শুধু ব্রাজিলিয়ান মডেল হুলিয়ানার ক্ষেত্রেই এমন ঘটনা ঘটেছে বা হয়েছে এমন নয়। আমাদের দেশের অভ্যন্তরেও নারীর শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে প্রচুর কথা হয়। কে ফর্সা, কার গায়ের রঙ চাপা, কে শ্যাম রঙের বা কালো, কোন নারী মোটা আর কে বা শুকনো; এমন নানা ধরনের তকমা নারীর সৌন্দর্যের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। যা শুধু অন্যায়ই নয় বরং মানুষের বিকৃত মনের পরিচয়ও বটে।
দৈহিক বা শারীরিক গঠনের নানা শ্রেণির বিভেদ মানুষকে প্রচণ্ড পরিমাণে নেতিবাচক চাপ প্রয়োগ করে। যার ফলে জীবনের প্রতি বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। এবং একজন মানুষ হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন। জীবনকে অসহ্য মনে হতে পারে। যে বা যারা শারীরিক গঠন বা গায়ের রঙ নিয়ে কটুকথা বলেন তাদের একবার ভাবা উচিত স্রষ্টার সৃষ্টি সবাই। যদি কারো ক্ষমতা থাকতো তবে তিনি অবশ্যই পৃথিবীর মাঝে সবচেয়ে পারফেক্ট হওয়ার সর্বোচ্চ চেষ্টা করতেন। এটা ব্রাজিলিয়ান নারী মডেল হুলিয়ানা নেহেমের ক্ষেত্রে যেমন সত্যি ঠিক প্রত্যেকটা মানুষের জন্য। ফলে এই ধরনের মানসিক দৈন্য থেকে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্রকে বেরিয়ে আসতে হবে। মানুষকে তার নিজস্বতায় বিশ্বাসী হতে শেখাতে হবে। এবং শুধু শেখালে হবে না বরং সবাইকে বিশ্বাস করতে হবে।
আজকাল পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পড়ে সুইসাইডের ঘটনা। এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে ডিপ্রেশন, মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, হতাশা। এই বিষয়গুলোর জন্ম একদিনে হয় না। বরং ধীরে ধীরে একটি মানুষের মধ্যে তার বীজ বপন করে দেওয়া হয়। এ সমাজ যখন তার দিকে আঙুল তুলে প্রতিনিয়ত বলতে থাকে, তুমি পারফেক্ট নও। এ পৃথিবীর যোগ্য নও। তোমার গায়ের রঙ কালো, তুমি মোটা, বেটে, নাক বোঁচা, বুদ্ধি নেই, পড়াশোনায় ভালো নয় এমন হাজারো রকমের নেতিবাচক কথা। এসব কথা যাকে উদ্দেশে করে বলা হচ্ছে, সে ব্যক্তি তো কোনো একজন থেকে এই কথাটি শুনছেন না বরং স্থান, কাল ভেদে শুনেই আসতে হচ্ছে।
একটা সময় সে বা এই শ্রেণি এতটাই তলিয়ে যেতে থাকে যার ফলে তার অস্তিত্বের সংকট দেখা দেয়। তখনই তারা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটাতে দ্বিধা করে না। ফলে যারা আত্মহত্যা করে, বিষণ্ণতা, হতাশায় ভোগে তার আমাদের পরিবার, সমাজের। এই ধরনের মানসিক বিকৃতি, দৈন্যের আশু পরিবর্তন হওয়া জরুরি। আমরা আধুনিক মানুষ। পশুর সঙ্গে একদিন লড়াই করে টিকে ছিল কিন্তু আজকাল মানুষের সঙ্গে লড়াই করতে না পেরে মানুষ পরাজয় বরণ করছে। কারণ পশুর হিংস্র রূপের চেয়ে মানুষের মুখের জবান আরও তির্যক, কঠিন, রূঢ়।
গায়ে আঘাত করা হলে সে ঘা দ্রুত শুকালেও মনের আঘাত বা ক্ষত সহজে সেরে ওঠে না। তাইতো বলা হয় বন্দুকের গুলি আর মুখের বুলি দুটোই মারাত্মক ভয়াবহ। তাই মানুষের প্রতি বিনম্র হওয়ার শিক্ষা গ্রহণ করি। মানুষকে তার নিজস্বতা দিয়ে বিচার করি। মানুষের ভিন্নতা মানব জাতির বৈশিষ্ট্য সেটাকে স্বীকার করতে দ্বিধা না করি। জয় হোক মানবতার। জেগে উঠুক শুভবুদ্ধি । সৃষ্টি হোক মনুষ্যত্বের। গড়ে উঠুক মানবের প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা।