Skip to content

৮ই মে, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | বুধবার | ২৫শে বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মীর মশাররফের ‘মায়মুনা’: খল চরিত্রের প্রতিবিম্ব

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মীর মশাররফ হোসেন একজন অসাধারণ প্রতিভার অধিকারী শিল্পী। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে বাংলা গদ্যের প্রচলন শুরু হলেও মুসলমানরা উনিশ শতকের শেষদিকে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠার পর ফরাসির বদলে ইংরেজি রাজভাষার স্থান দখল করে। কিন্তু মুসলমানগণ ইংরেজি শিক্ষায় অগ্রসর হননি, এমনকি সাহিত্য চর্চা থেকে তাদের অবস্থান ছিল যোজন যোজন দূরে।

উনিশ শতকের শেষদিকে মুসলমানরা ধর্মীয় বিষয়বস্তু অবলম্বনে সাহিত্য সাধনায় আত্মনিয়োগ করেন। ধর্মীয় মাহাত্ম্য প্রচারই ছিল তাদের সাহিত্য সাধনার মূল উদ্দেশ্য। মীর মশাররফ হোসেন উনিশ শতকের শেষদিকে সাহিত্য জগতে প্রবেশ করেন। তার দীপ্তিময় প্রতিভা আজও তাকে বাংলা সাহিত্য জগতে অবিস্মরণীয় করে রেখেছে।

মীর মশাররফ হোসেন সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা, জীবনীগ্রন্থ; সবই তিনি রচনা করেছেন। মুসলিম ঐতিহ্য, বাস্তব ঘটনা, ধর্মীয় বিষয়বস্তুকে কেন্দ্র করে তিনি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার ‘বিষাদসিন্ধু’ তিন পর্বে প্রকাশিত হয়। কারবালার বিষাদময় কাহিনি অবলম্বনে এটি রচিত। এর কাহিনি রূপায়ণে লেখক জঙ্গনামা, মুক্তাল হোসেন ইত্যাদি কল্পনাশ্রয়ী পুঁথির অনুসরণ করেছেন। ঐতিহাসিক চরিত্রের পাশাপাশি এখানে কাল্পনিক চরিত্রও সৃষ্টি করেছেন লেখক। যা কাহিনিকে পাঠক মহলে আকর্ষণীয় করে তুলতে সহয়তা করেছে।

গ্রন্থটিতে অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ ঘটলেও এর প্রধান নারী চরিত্র জয়নাব। যার রূপ তৃষার অপ্রতিরোধ্য গতি সঞ্চারিত হয়েছে এজিদের মধ্যে। জয়নাবের রূপ মাধুর্যের কামনায় এজিদ ধীরে ধীরে অপরাধ সংঘটিত করেছে। আর এই অপরাধকে গতিপ্রবণ করেছে এই গ্রন্থটির অন্যতম খল নারী চরিত্র মায়মুনা। পাষণ্ড এই দাসী মায়মুনার ফাঁদে পা দিয়ে ইমাম হাসানের স্ত্রী জায়েদা স্বামীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। মায়মুনা দাসীরূপী এক পাষণ্ড নারী চরিত্র।

বিশেষ উদ্দেশ সাধনের জন্যই এ চরিত্রের সৃষ্টি। এজিদের সেনাপতি মারোয়ানের কাছ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে মায়মুনা। এর ফলে ষড়যন্ত্রের জাল বোনে। সেই জালে ধরা ইমাম হাসানের দ্বিতীয় স্ত্রী জায়েদা। ঈর্ষাপরায়ণ জায়েদা মায়মুনার কথায় প্ররোচিত হয়ে নিজ হাতে স্বামীকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। মায়মুনার এই কুটচালে ইমাম পরিবারের স্তম্ভ খসে পড়ে। পরবর্তীকালে পুরোপুরি ধ্বংস হয়।

মায়মুনা চরিত্রটি মধ্য যুগের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের দুর্বলা দাসীর সঙ্গে তুলনা করে চলে। অর্থের জন্য ষড়যন্ত্র করতেও তার বাধেনি। মায়মুনা চরিত্রটি বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত খল নারী চরিত্র। যে কিনা স্বার্থান্বেষী, ঠক, প্রতারক, ষড়যন্ত্রকারী হিসেবেই সাহিত্যে স্থান করে নিয়েছে। মায়মুনার প্ররোচনায় জায়েদা পথভ্রষ্ট হয়। আমাদের সমাজে মায়মুনাদের অভাব নেই। সাহিত্যের রসে চরিত্রটি গড়ে উঠলেও মায়মুনা চরিত্র বাঙালি সমাজ জীবন থেকে গৃহীত। আমাদের সমাজে মায়মুনারা কিঞ্চিৎ স্বার্থের জন্য মানুষকে অবলীলায় মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে।

মুসলিম ঐতিহ্যকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও বিষাদসিন্ধু হৃদয়ের কথা বলে। তবে কাল্পনিক আশ্রয় কখনো কখনো অতিরঞ্জিত হয়েছে। তবে বাঙালি মুসলমান সবসময়ই এই গ্রন্থকে ধর্মের আবরণে বিচার করেছে ফলে এর প্রকৃত রস থেকে পাঠক বঞ্চিত হয়। সাহিত্যকে জীবনের সঙ্গে একাত্ম করে উপলব্ধি করতে পারলে সাহিত্যের প্রকৃত রস আস্বাদন করা সম্ভব। সাহিত্য হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী। বিষাদ সিন্ধু লেখকের অভিনব রচনা। এর মাধ্যমে ইসলামিক ঐতিহ্য, অপূর্ব ভাষাশৈলী, মানবিক আবেদন, আকর্ষণীয় গল্পরস প্রকাশিত হয়েছে। মীর মশাররফ হোসেনের বিষাদ সিন্ধু কালজয়ী।

ইতিহাস আশ্রিত করুণ কাহিনির অনবদ্য সুর ধ্বনিত হয়েছে এতে। তাই মীর মশাররফ হোসেন আজও স্বমহিমায় ভাস্বর হয়ে আছেন।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ