বিজয়ের মাসে নারীর স্বাধীনতাও স্বীকৃতি পাক
প্রত্যেক প্রাণীই স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে চায়৷ অর্থাৎ প্রত্যকেই স্বাধীনতাকামী। একটি পাখিকে যখন খাঁচায় পুরে পোষ মানানোর চেষ্টা করা হয়, ভালো মতো যত্ন নেওয়া হয়, তখনো সে খাঁচা খোলা পেলেই মুক্ত আকাশে উড়াল দেয়। কারণ সেই মুক্ত আকাশই পাখিটির পৃথিবী। তাকে ঘরের শোভা বৃদ্ধির জন্য বা আদর করে খাঁচা বন্দি করলে সে থাকে না। তবে মানুষ জাতি ভিন্ন ধাঁচের। ভালোবাসা পেলে তারা সব ভুলতে থাকে। তবু সেই ভালোবাসার নামে যখন চলে প্রহসন তখন মানুষ আর সহ্য করতে পারে না। এই জগতে সবচেয়ে বেশি প্রতারণা, প্রবঞ্চনা, প্রহসনের শিকার নারী।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজ তাকেও পোষমানা পাখিটির মতোই নানাবিধ শেকলে আটকে ফেলে। নিজস্ব স্বাধীনতা, প্রাপ্তি বা প্রাপ্যের যোগ্য সম্মান, মূল্যায়ন এমনকি নূন্যতম শ্রদ্ধা থেকেও নারীকে বঞ্চিত করে! একটি কন্যা শিশু জন্মগ্রহণের পর থেকেই তাকে পোষমানা পাখির মতো খাঁচায় বন্দি করা হয়। তবে সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, এই নারীদের অধিকাংশই কারও ভালোবাসা, সম্মান, শ্রদ্ধা ও যোগ্য মূল্যায়ন কোথাও পায় না। বরং তার কাছ থেকে এগুলো টেনে-হিঁচড়ে করায়ত্ত করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ।
পরিবার থেকে নারীর সঙ্গে শুরু হয় বৈষম্যমূলক আচরণ। নারীর ভালো-মন্দলাগা সম্পর্কে পরিবারের কোনই ভ্রূক্ষেপ থাকে না। কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থা গড়েই উঠেছে নারীকে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করার জন্য। নারীরা বিয়ের পূর্বে পিতার ঘরে আমনত হিসেবেই থাকেন। তবে সেই আমানত রক্ষার দায় যেহেতু বাবা- মায়ের, তাই তারা কন্যাসন্তানের প্রকৃত বেড়ে ওঠার ওপর লেবেল এঁটে দেয়। কী কী করতে পারবে, আর কী পারবে না; তাও নির্ধারণ করে দেয়। কোথায় যাওয়া উচিত আর কোথায় নয়, প্রভৃতি নীতিনির্ধারণী শক্তি থাকে পরিবারের সদস্যদের হাতে। তাই কন্যাশিশুকে তারা ওভাবেই নাকে দঁড়ি দিয়ে ঘোরাতে চেষ্টা করে। অধিকাংশ নারী বেড়েও ওঠে ঠিক এভাবেই। যারা সংসার-সন্তান-বিয়ে; এই ঘোরটোপের বাইরে এসে উন্মুক্ত, স্বাধীন জীবনযাপন করতে পারে না। মনের প্রকৃত বিকাশ ঘটাতে পারেন না।
পরিবার নারীকে প্রকৃত বেড়ে ওঠার পরিবেশে বিঘ্ন ঘটান। একজন মানুষ স্বভাবতই বাধার সম্মুখে নিজের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটাতে অক্ষম। আমাদের সমাজে মেয়েদের সঙ্গে হীন মানসিকতা নিয়েই তাদের প্রতি রূঢ় আচরণ করেন পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। যার দায় নারীকে আজীবন বহন করতে হয়। পরিবারেই নারী যে বঞ্চিত জীবনের সূচনা হয় তারপর স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পার হয়ে যখন কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করেন সেখানেও নারীদের সঙ্গে চলে বৈষম্যমূলক আচরণ। নারীর স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করতে থাকেন সবাই।
তাই বিজয়ের মাসে এটাই কাম্য জাতির বিকৃত মানসিকতা থেকে নারী স্বাধীনতা গড়ে ওঠুক। মুক্ত বিহঙ্গের মতো নারী তার মত-পথকে প্রসারিত করুক আপন মহিমায়।
পরিবার, সমাজ নারীকে সবসময় একটা গণ্ডিতে আঁটকে নারীর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করার পায়তারা করেন। আধুনিক যুগে এসেও নারীকে চলতে হচ্ছে পরিবার, সমাজের চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম-নীতির ওপর ভর করে। নারী তার নিজস্ব ইচ্ছে, চাহিদা, আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারছে না। যখনই নারীরা এই গণ্ডি ভেঙে বেরিয়ে আসতে চায় তখনই একদল হীন মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের গাত্রদাহ হয়। নারীর স্বাধীনভাবে চলাচল, স্বাধীন মত প্রকাশে বাধা দেয়। সবার জীবন একই রেখায় চলে না। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমাদের সমাজের চাপিয়ে দেওয়া বোঝা এমনই যে, না চাইলেও ওই সবাই যে নিয়মে জীবন পালন করে সেই মতোই করতে হবে। দিনশেষে নারীটির দুবেলা দুমুঠো খাবার জুটলো কিনা সে বেলায় কারো মাথাব্যথা থাকে না। শুধু সমাজের চোখ গিয়ে দাঁড়ায়, যদি নারীটি চাকুরিজীবী হন তবে তিনি কখন বাসা থেকে বের হলেন, কখন ঢুকলেন, কার সঙ্গে কথা বলছেন, কী করছেন তার দিকে। সহমর্মিতা তো এ সমাজে গড়ে ওঠেইনি৷ বরং চোখ ট্যারা করে নারীকে কুৎসিত কথা বলতেও এই বিকৃত রুচিসম্পন্ন মানুষের মুখে বাধে না।
সময় বদলেছে অনেক। কিন্তু চিন্তাধারায় নেই কোনই পরিবর্তন। আমরা ওপরে ওপরে অনেক পরিবর্তনের গল্প বলি কিন্তু আদৌ এ সমাজের মানসিকতা পরিবর্তন হয়েছে কি? প্রত্যেক নারী রাস্তায় বেরুলেই টের পান তার প্রতি পুরুষের নজরটা কেমন, গণপরিবহনে যদি ২ জন পুরুষ যাত্রী দাঁড়িয়ে থাকেন সেখানে তাদের কোনই সমস্যা নাহলেও নারীটিকে ঠিক ধাক্কা খেতে হয়। পুরুষ যাত্রীরা ওঠা-নামার সময় একটু গা-ঘেঁষে এলিয়ে পড়ে নিজেদের বিকৃত মানসিকতা ঘোচানোর চেষ্টা করেন। নারীর নিরাপত্তা যেমন রোহিত তেমনই একজন নারী তার কথাটাও অনেক সময় বলতে পারেন না। কারণ এরফলে সবাই নারীর দিকেই আঙুল তোলে।
দাম্পত্য সম্পর্কে কলহ দেখা দিলে, বিচ্ছেদ ঘটলে, শ্বশুরবাড়ি মানিয়ে নিতে না পারলে সেখানেও নারীর প্রতিই সবার নজর আঁটকে থাকে। আর পরিবার, পরিজন, আত্মীয়- স্বজনরাও নারীর দিকেই আঙুল তোলে। তার নিজস্ব মত প্রকাশের ক্ষমতা থাকে না। চাপিয়ে দিয়ে ক্ষান্ত থাকে পরিবার- সমাজ। কিন্তু নারীর স্বাধীন সত্তা আছে। ভালোলাগা- মন্দলাগা আছে। নারী নিজের মনের কথাটা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে চায়। সেই প্রকাশে কেনোই বা নারীর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করা হবে?
আধুনিক যুগের ছত্রছায়ায় দাঁড়িয়ে মানুষ হিসেবে আমরা একটু আধুনিক মননের অধিকারী হই। অন্যের বিষয়ে নাক না গলিয়ে বরং ব্যক্তির স্বাধীন সত্তাকে শ্রদ্ধা করতে শিখি। নারী নিজ স্বাধীনতায় তার প্রকৃত মুক্তি ঘটাক। নারীর কল্যাণ জাতির কল্যাণ। তাই বিজয়ের মাসে এটাই কাম্য জাতির বিকৃত মানসিকতা থেকে নারী স্বাধীনতা গড়ে ওঠুক। মুক্ত বিহঙ্গের মতো নারী তার মত-পথকে প্রসারিত করুক আপন মহিমায়।