শীতে বয়স্ক নারীদের যত্নআত্তি
শিশু থেকে বৃদ্ধ বয়সে পদার্পণ করা কঠিন সত্য। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয় খাবারের ধরনের। এই বয়সে খাবারের চাহদা বাড়ে না কমে তা নিয়ে দ্বিধায় থাকেন অনেকেই।
সাধারণত, ৬০ বছর বয়স সীমাকে বৃদ্ধ ধরা হয়। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক, মানসিক ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়ে। আর শীতকাল হলে যেন এই সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করে। বয়স্কদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় অল্প ঠাণ্ডায়ও তাদের নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে। শীতের এই সময়ে তারা ভোগেন নানা রোগে। সতর্ক পদক্ষেপ নিলে এবং শীত থেকে রক্ষা করতে পারলে অনেক ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয় না।
শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা
বয়স্ক মানুষের কমন সমস্যা শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা বা শ্বাসনালির প্রদাহ, যা ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় বাড়তে পারে। এ ছাড়া শীতের সাধারণ সর্দি-কাশি থেকে হতে পারে নিউমোনিয়া কিংবা অ্যাজমা। অনেক সময় এতে প্রাণহানিও ঘটতে পারে। যাদের অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্টজাতীয় সমস্যা প্রকট, তাদের উচিত সব সময় গরম কাপড় পরা, গরম পানি পান ও ব্যবহার করা। ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় ঘরের বাইরে যাওয়া উচিত নয়। \
বিশেষ প্রয়োজনে বাইরে গেলে অবশ্যই কানটুপি, মাফলার, জুতা-মোজা, হাতমোজাও ব্যবহার করা উচিত। যাদের অ্যাজমা আছে, তাদের সব সময় ইনহেলার প্রস্তুত রাখতে হবে। প্রয়োজন হলেই ব্যবহার করতে হবে। যে বাড়িতে অ্যাজমার রোগী আছে, সেখানে কার্পেট ব্যবহার না করাই ভালো। পোষা প্রাণী থেকে তারা দূরে থাকবেন। সমস্যা বেশি মনে হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জয়েন্ট পেইন
যাদের আগে থেকেই রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিস, অস্টিও-আর্থ্রাইটিস ও অন্যান্য অস্থিসন্ধি বা বাতজনিত ব্যথা ছিল, তাদের এসব সমস্যা শীতে কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। এছাড়া অ্যানকাইলোজিং স্পন্ডিওলাইটিস, স্পন্ডাইলো আর্থ্রাইটিস, রি-অ্যাকটিভ আর্থ্রাইটিস ইত্যাদি সমস্যাও বাড়ে। এসবের মূল কারণ অবশ্য শীত নয়, বরং শীতকালে কাজকর্ম, শারীরিক পরিশ্রম বা নড়াচড়া কম হয় বলে এই সমস্যাগুলো বাড়ে। তাই শুধু শুয়ে-বসে না থেকে যতটা সম্ভব বয়স্কদের সক্রিয় বা প্রাণবন্ত রাখার চেষ্টা করতে হবে।
ঘরের ভেতর হাঁটাহাঁটিসহ হাত-পা নড়াচড়ার মতো হালকা ব্যায়ামগুলোর অনুশীলন করাতে হবে। এতে শরীরে তাপ উৎপন্ন হবে, শীত কম লাগবে। তা ছাড়া এসব সমস্যা সমাধানে ও শরীরের জন্য ভিটামিন ‘ডি’ খুবই দরকারি। এর ৮০ শতাংশ উৎস হচ্ছে সূর্যের আলো। সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ মিনিট রোদ পোহাতে দিন।
রেনোড ফেনোমেনন
তীব্র ঠাণ্ডায় হাত-পা নীল হয়ে যাওয়াকে ‘রেনোড ফেনোমেনন’ বলে। এটা বাত রোগীদের বেশি হয়। এতে ত্বকে অস্বাভাবিক অনুভূতি হওয়া, রক্তপ্রবাহ সঠিকভাবে না হওয়া, হাতে ও আঙুলে ব্যথা, কবজি ফুলে যাওয়া, ত্বকের ক্ষত, মাংসপেশিতে ব্যথা ইত্যাদি হতে পারে। যাদের এই সমস্যা হয়, তাদের উচিত মোজা পরিধান করে থাকা, গরম সেঁক দেওয়া, ঘরেই হালকা মুভমেন্ট করা ও চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে চলা। এসব রোগীর বারবার পানি ব্যবহার করা নিষেধ।
মানসিক সমস্যা
প্রবল শীতে মানুষ অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, নানা মানসিক রোগ দেখা দেয়। প্রবীণ বা বৃদ্ধদের এই সমস্যা বেশি হতে পারে শীতের সময়। তখন তারা সব কিছু থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ভাবতে শুরু করেন। ট্রমা ও বিষণ্নতায় ভোগা এসব মানুষের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। এ সময় পরিবারের অন্য সদস্যদের তাদের সঙ্গে বেশি সময় দেওয়া উচিত। বিশেষ করে তাদের নিয়ে একসঙ্গে টেলিভিশন দেখা বা গল্প করার কাজটি করা উচিত। তারা যেন একা একা না থাকেন সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে।
চর্মরোগ
শীত এলেই কিছু চর্মরোগ নতুন করে আবির্ভূত হয়, যা গরমকালে খুব একটা দেখা যায় না। বিশেষ করে চামড়ার শুষ্কতা, চুলকানি, হাত-পা ফেটে যাওয়া, মুখে-জিহ্বায় ঘা ছাড়াও নানা ধরনের চর্মরোগ বা খোস-পাঁচড়া বেশি দেখা দেয়। এ সময় বয়স্কদের বিশেষ যত্ন নিতে হবে, কেননা এসব রোগের প্রবণতা তাদের বেশি থাকে। তাই তাদের বিছানা বা পরনের কাপড় যথেষ্ট পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখুন। হাত-পায়ের তালু ও ঠোঁটে পেট্রোলিয়াম জেলি ব্যবহার করতে দিন। ত্বকের সুরক্ষায় ময়েশ্চারাইজার যেমন—ভ্যাসলিন, গ্লিসারিন, অলিভ অয়েল ও সরিষার তেল ব্যবহার করুন। তবে বেশিক্ষণ রোদে থাকা বা কড়া আগুনে তাপ পোহানো ঠিক নয়। এতে চামড়ায় সমস্যা তৈরি হয়।
হাইপোথার্মিয়া
এটি এমন একটি অবস্থা, যখন কারও তাপমাত্রা স্বাভাবিকের (৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা ৯৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট) তুলনায় কমে যায় এবং বিপাকীয় কার্যাবলি স্বাভাবিকভাবে সম্পন্ন হয় না। অতিরিক্ত শীতে বয়স্কদের এ সমস্যা বেশি হয়। তখন শরীরে কাঁপুনি শুরু হয়, সে স্বাভাবিক ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না। এ সময় দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে হাত-পা বেশি ঠাণ্ডা হয়ে অঙ্গগুলো বিকল হয়ে যেতে পারে। এ রকমটি দেখা দিলে রোগীর শরীর দ্রুত গরম করার ব্যবস্থা করতে হবে। তাৎক্ষণিক গরম দুধ, চা, কফি বা স্যুপ খাওয়ানো যেতে পারে। রোগীর গায়ের পোশাক ঢিলেঢালা ও আরামদায়ক কি না, সেটিও খেয়াল রাখতে হবে।
খাবার-দাবার
♦ প্রতিদিন শীতের শাকসবজি, বিশেষ করে গাজর, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি ইত্যাদি খেতে দিন।
♦ খাদ্যতালিকায় ফলমূল, ভিটামিন, মিনারেল ইত্যাদি রাখুন, যা শীতে সুস্থ থাকতে সাহায্য করবে।
♦ সব সময় গরম গরম খাবার পরিবেশন করুন।
♦ পানি কম পান করলে কিডনির কার্যক্ষমতা নষ্টসহ নানা জটিলতা তৈরি হতে পারে। এ জন্য গরম পানি ও কেমিক্যালমুক্ত দেশি ফলের রস পান করতে দিন।
অনন্যা/নুপুর