‘মহাগায়িকা’ গীতা দত্ত
একসময় বাংলায় কি বোম্বে, গীতা দত্ত ছিলেন তার প্রাণ। এখনো রয়ে গেছে তার অবিস্মরণীয় সব গান। জন্মেছিলেন রাজার হালে অর্থাৎ ফরিদপুরের জমিদার বাড়িতে। ঘর থেকেই গানের পরিবেশে যাতায়াত শুরু করেন। তবে সেই আরাম বেশিদিন থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব তার পরিবারেও পড়েছিল। শুধু তার পরিবার কেন, পুরো ভারতেই পড়তে শুরু করেছিল।
সেরা নেপথ্য গায়িকার রাজমুকুট লতা মঙ্গেশকরেরও আগে এসেছিল গীতা দত্তের শিরে। তিনিই ছিলেন সেই সময়ে তামাম ভারতের নারী ‘সিংগিং-সুপারস্টার’। লুকিয়ে-চুরিয়ে আজও বলা হয়, ‘লতাকণ্ঠী, আশাকণ্ঠী হওয়া যায়। কিন্তু গীতাকণ্ঠী হওয়া যায় না।’ তার কারণ, তিনি অননুকরণীয়। তার স্বরযন্ত্রটা আসলে ঈশ্বরের নিজের তৈরি মোহনবাঁশি। তিনি ভীষণ আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তাই তার সুরে রোম্যান্স, উৎসব, যন্ত্রণা, ছলনা—সব অমন তীব্রভাবে বেজে উঠতো।
আজ গীতা দত্তের জনপ্রিয় দশটি গানের বিশ্লেষণ দেওয়া হলো:
মেরা সুনদার সাপনা
‘বর্মণদা কি ধুনমে গীতা রয় কি সুনহেরি সরগম। ফিল্ম শবনম।’ রেডিওর নব ঘোরালেই এমন কথা পঞ্চাশের দশকে হরহামেশা শোনা যেতো। গীতার করুণ গলায় সমর্পণের আকুতি খুব ভালোভাবে ফুটে উঠতো। শচীন দেববর্মণ ‘দো ভাই’ ফিল্মে তাকে নয়টি গান দিয়ে বসলেন। নতুন মেয়েটির কণ্ঠে রাগ ছন্দ ভালো লাগলো তার। এই গানে গীতার কণ্ঠের অভিমান, হৃদয়বৃত্তি আর নারীর অহংই ফুটে উঠলো। পর্দায় সুন্দরী নায়িকার ঠোঁটে মিলিয়ে গেলো সেই সব গান। আর দর্শককে নতুন করে উজ্জিবীত করে তুললো।
অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল জিনা ইহাঁ
দেশপভাগের কাটাদাগ তখনো বেশ দগদগে। তবু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। এমন সময় প্রথাগত তালিম ছাড়াই গলার অসাধারণ এক্সপ্রেশন রেঞ্জে শ্রোতাদের বুদ করে রাখলেন এই গানটি দিয়ে। গানের কথাগুলো বোম্বের যান্ত্রিকতায় প্রেমে মত্ত যুগলের আবেগকে তুলে ধরে। এখানে এই যন্ত্রণাকাতর পরিবেশে বেঁচে থাকা মুশকিল। এসব গানে প্রাণ এনে দিয়েছিলেন গীতা। তবু এখানেই যেন ভালোবাসা জিইয়ে আছে দুজনের মধ্যে।
পেয়ার মে জ়রা সমহলনা…
গুরু দত্তের সঙ্গে বিয়ের পর গীতাকে কিছুটা বাধাবিঘ্নের মুখে পড়তে হয়েছিল। কিন্তু এসময় নিজের প্রতিভাকে বিকশিত করার সুযোগ হাতছাড়া করেন নি। এই গানটিতে গিতার যে মাদক স্বর তাকে ব্যবহার করার সুযোগ তখন পরিচালক ও পি নাইয়ারের হাতে এসেছিল। কিন্তু গীতার সাংসারিক ছন্দ আর কাজের গুরুভারের সামঞ্জস্যের সময়েও এমন একটি গান আমরা পেয়েছি সেটাও কম আনন্দের নয়।
মেরা নাম চিন চিন চু
বিয়ের পর গুরু দত্তের শর্ত, সংসার ও সন্তানের অগ্রাধিকার বিবেচনায় গীতাও কেমন যেন পিছিয়ে পড়ছিলেন। এরমধ্যেও বছরে একটি কি দুটী সিনেমা গীতার গান পেয়ে যেত। সেসব গানই যেন তুরুপের তাস হয়ে উঠতো। এরমধ্যে একবার শক্তি সামন্তের ‘হাওড়া ব্রিজ’ চলচ্চিত্রে আবার গীতার কাজ করার সুযোগ এলো। এই গানটিতে ভায়োলিন, ড্রামবাদ্য, আর হেলেনের তুফান নৃত্য সব আছে। কিন্তু গীতা যদি মেরা নাম চিন চিন চু গানটিতে গলা না মেলাতেন তবে এই গানটি এতদূর আসতোই না। একবার তো হেলেন সাক্ষাৎকারে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘দিদি আগুন লাগিয়ে দিতেন গানে। শটে আপনিই আমার সেরাটা বেরিয়ে আসত! কেয়া শোখি, জজ়বাত, অদা, নজ়াকত!’এই গান গাওয়ার পর অনেকে বুঝলেন গীতা ক্যাবারে গানেও মাত করে দিতে পারেন।
তুমি যে আমার
মাঝেমধ্যে একটা রোল ফিল্মপাড়ায় তখন পাওয়া যেতো। গীতা দত্ত নাকি ফুরিয়ে গেছেন। কদিন পর আসমুদ্রহিমাচল কাঁপানো জনপ্রিয়তা নিয়ে তিনি আবার ফিরতেন। তুমি যে আমার গান্টিও তেমনই একটি গান। উত্তম-সুচিত্রা-হেমন্তের সঙ্গে কাজ করে বাংলা গানের জ্বলজ্বলে এক রত্ন এটি।
‘ওয়ক্ত নে কিয়া কেয়া হসিন সিতম!’
কিছু কিছু গানে যিনি গান তার খেদও ধরা পড়ে। ফিল্মপাড়ায় তখন ‘কাগজ কে ফুল’ এর একটি গান নিয়ে তুমুল আলোচনা। গুরু দত্তের সঙ্গে নবাগতা নায়িকা ওয়াহিদার সম্পর্ক নিয়ে গুজব রটে গেছে। সেই গুজব যেন অনেকটা সত্যই হয়ে উঠলো যখন গুরু দত্ত ও নায়িকা জুটি বেঁধে ‘কাগজ কে ফুল’ ছবিতে জুটি বাধলেন। এই গানে খেদ নিয়ে গলা দিলেন গীতা। তারপরের গল্পটি করুণ। আরও ভয়াবহ।
ননহি কলি শোনে চলি
এসডি বর্মণ নাকি গীতার জন্য তুলে রাখা গান অন্যদের দিতে রাজি হতেন না। যখনই জানতে পারতেন গীতার গাওয়া গান কোনো সিনেমায় যাবে, রাতদিন এক করে গানে সুর তুলতেন। অর্থের অনটন তখন গীতার জীবনে প্রবল। বাংলা সিনেমায় তখন গান গাইতেন। এসডি বর্মনের যে গানটি এখনও অসংখ্য শ্রোতাকে মুগ্ধ করে এই গানটি তার একটি।
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা এই গানটিও তখন বাংলা সিনেমায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। প্রেমিক প্রেমিকারা সন্ধ্যের আগমুহূর্তে একান্তে বিকাল উপভোগের আগে একে অপরকে এই গানে মুগ্ধ করেছেন।
অনন্যা/এআই