গাড়িচাপায় নারীর মৃত্যু: এই বর্বতার শেষ কোথায়
দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে জন্ম দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের। আধুনিক, প্রগতিশীল, সাম্য, সমতা, সবার জন্য ন্যায়বিচার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার রাষ্ট্রদর্শন নিয়ে যাত্রা শুরু করে দেশটি।
এরপরই ঘটে জঘন্যতম ঘটনা। পঁচাত্তরে সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়েই শুরু হয় বাংলাদেশের উল্টোপথে যাত্রা। যা আজও থামেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও বাংলাদেশে নিরাপদে চলাচলের নিশ্চয়তা আমরা পাইনি। সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর থেকে ঘরে হত্যা, নগরে হত্যা, সড়কে হত্যা, হত্যার এই বহুমুখী রূপের কোনো পরিবর্তন হয়নি। এই তো ডিসেম্বরের ৩ তারিখে তৈরি হলো বর্বরতার আরেক ইতিহাস।
ঘটনাটি শুনে মনে হবে, আদিম সমাজের কিছু জংলি মানুষের কাণ্ড। কিংবা প্রাচীন ও অন্ধকার আফ্রিকার হিংস্র জাতিগোষ্ঠীর পশ্চাৎপদ গোত্রীয় বর্বর তৎপরতা। কিন্তু আসলে তেমন নয়। ঘটনাটি বাংলাদেশেরই। চলমান একুশ শতকের বিজ্ঞান-শিক্ষা-প্রযুক্তি ও প্রগতিশীরতার যুগেই ঘটেছে।
রুবিনা আক্তার নামের এক নারী মোটরসাইকেলে চড়ে রাজধানীর তেজগাঁও থেকে হাজারিবাগ যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে একটি প্রাইভেটকার এসে ধাক্কা দেয় তাদের। এই সময় সে বাইক থেকে ছিটকে গাড়ির বাম্পারে আটকে যায়। গাড়িটি না থামিয়ে গাড়ি চালক তাকে ঢাবি কেন্দ্রীয় মসজিদ থেকে নীলক্ষেত পর্যন্ত টেনে নিয়ে যান। ওই নারীকে চাপা দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া গাড়ির চালক আর কেউ নন, তিনি দেশের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চাকরিচ্যুত শিক্ষক মোহাম্মদ আজহার জাফর শাহ। নৈতিক স্খলনজনিত কারণে ২০১৮ সালে তাকে চাকরিচ্যুত করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
বিষয়টি দেখার পর শিক্ষার্থী ও পথচারীরা ধাওয়া করে গাড়িটি আটক করে। উৎসুক জনতার বেশিরভাগই তখন ব্যস্ত ছিল ঘটনাটি ভিডিও করতে। আবার খুব বেশি উৎসুক কিছু জনতা ওই গাড়ির ড্রাইভারকে মারধর করতে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু কেউ ওই নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার কথা ভাবেনি। তবে, শেষ পর্যন্ত ২/৩ জন এসে ওই নারীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যায়। বিকেল পৌনে ৫টায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এই ঘটনাটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, একটি স্পষ্ট হত্যাকাণ্ড। যেই হত্যাকাণ্ডের পেছনে জড়িত সেরা বিদ্যাপীঠের মহান শিক্ষক। তার সঙ্গে সাধারণ জনতাও। সবার নৈতিকতার ওপর উঠছে প্রশ্ন।
এই গাড়ির চালক বা দুর্ঘটনা দেখেও তাকে সাহায্য করার বদলে মুঠোফোনে ভিডিও করা জনতাকে আমার মানুষ ভাবতে কষ্ট হয়। মানবতাবোধের অভাব যাদের আছে, তাদের মানুষ বলা যায় না। তারা নরাধম। একটি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়ে যার মধ্যে নৈতিকতা নেই, মানবতা নেই, সেই শিক্ষকের দেশ ও দশের উন্নয়নে প্রয়োজন নেই।
আজকাল আমাদের মধ্যে মূল্যবোধের বড়ই অভাব। অথচ বর্তমানে সবথেকে বেশি প্রয়োজন এই মূল্যবোধ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে এখন থেকেই শেখাতে হবে মানবতাবোধ ও মূল্যবোধ।
মূল্যবোধ সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি। এটি মানুষের আচরণের সামাজিক মাপকাঠি। একটি দেশের সমাজ, রাষ্ট্র, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উৎকর্ষের অন্যতম মাপকাঠি হিসেবে এটি ভূমিকা পালন করে। জীবনের বিভিন্ন স্তরে আচরণ সম্পাদনের ক্ষেত্রে ভিন্ন ধরনের মূল্যমান বা আর্দশমান থাকা স্বাভাবিক। সুতরাং, ব্যক্তিজীবনের মূল্যবোধ, তার আচরণক্ষেত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ভিন্নরূপ গ্রহণ করতে পারে।
জীবনের প্রত্যেকটি মূল্যবোধের ক্ষেত্রে দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো তার প্রকাশমান দিক, যাকে আচরণমূল্যে পরিমাপ করা যায়। অন্যটি হলো তার আন্তরিক দিক, যাকে তাৎক্ষণিকভাবে পরিমাপ করা যায় না। মূল্যবোধের এই আন্তরিক দিকটিকে জীবনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। অনেক চিন্তাবিদ মনে করেন, শিক্ষা যেহেতু একটি আদর্শ সামাজিক প্রক্রিয়া, সেহেতু তার একমাত্র দায়িত্ব হওয়া উচিত, মূল্যবোধের এই আন্তরিক দিকটি বিকাশের চেষ্টা করা। শিক্ষাবিদরা মনে করেন, শিক্ষার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে অন্তত চার ধরনের মূল্যবোধ বিকাশের চেষ্টা করা প্রয়োজন। এগুলো হলো: ১) সামাজিক মূল্যবোধ, ২) নৈতিক মূল্যবোধ ও ৩) ধর্মীয় মূল্যবোধ।
সুতরাং পরিকল্পিত শিক্ষার মাধ্যমে উপভোগ্য বস্তুসামগ্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত আনন্দানুভূতির সংযোগ স্থাপন করে ব্যক্তিজীবনে অর্থনৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা যায়। ব্যক্তির আর্থিক কার্যাবলি পরিচালনার মাধ্যমে অর্থনৈতিক মূল্যবোধ প্রকাশ পায়।
সামাজিক মূল্যবোধ
যথাযথ পারস্পরিক সম্পর্ক স্থাপনের ওপর মানুষের সুস্থ সামাজিক জীবনযাপন নির্ভর করে। যে ব্যক্তি সুষ্ঠুভাবে সমাজে অন্তর্ভুক্ত অন্যান্য ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করতে সক্ষম তিনিই সুস্থ সামাজিক জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত।
মনোবিজ্ঞানীরা মনে করেন, ব্যক্তির আন্তরিক মূল্যবোধের মাধ্যমে উপযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গে যথাযথ সামাজিক সম্পর্ক নিরূপণ করা দরকার। যেমন, বন্ধুত্ব বলতে আমরা যে সম্পর্ককে বোঝাই তার মধ্যকার মানসিক সন্তুষ্টির মূলে আছে ব্যক্তির এ ধারণার প্রতি এক মূল্যবোধ। একে বলা হয় বন্ধুত্বের মূল্যবোধ। তেমনি স্নেহ, ভালোবাসাও একেকটি সামাজিক মূল্যবোধ। বর্তমানের বেশিরভাগ গাড়ি চালকের মধ্যে সামাজিক মূল্যবোধের অভাব রয়েছে। সামাজিক মুল্যবোধের অভাব ছিল বলেই একজন শিক্ষক হয়েও তিনি একজনকে ‘খুন করার মতো নিকৃষ্ট কাজ’ করতে পেরেছেন। আর সেখানে থাকা আমজনতা দুর্ঘটনার শিকার নারীকে সাহায্য না করে ছবি বা ভিডিওতে ব্যস্ত থাকতেন না। তাদের মধ্যে মূল্যবোধের জন্মই হয়নি।
নৈতিক মূল্যবোধ
জীবন চলার পথে ব্যক্তি তার কাজের পথ স্বাধীনভাবে বাছাই করে থাকে। পরিস্থিতি অনুযায়ী ব্যক্তির কী করণীয়, কী করণীয় নয় সে বিষয়ে প্রত্যেককে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। ব্যক্তির এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর তার জীবনের সফলতা বা ব্যর্থ হওয়া নির্ভর করে। এছাড়া এই সিদ্ধান্তের যথার্থতার মাধ্যমে ব্যক্তি জীবনের মূল্যমান নির্ধারণ করা হয়। নৈতিক মূল্যবোধ জাগরণের মাধ্যমে, ব্যক্তি সারা জীবন তার বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে আচরণগত সামঞ্জস্য বজায় রাখতে সক্ষম হয়।
জীবন-অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তির ভালো-মন্দ বা উচিত-অনুচিত বোধ তার মধ্যে জাগ্রত হয়। ব্যক্তির অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রের বিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে এই মূল্যবোধগুলো কেন্দ্রিভূত হয় এবং স্থায়িত্ব লাভ করে। আবার অভিজ্ঞতা অর্জনের প্রক্রিয়া হচ্ছে শিক্ষা। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে নৈতিক মূল্যবোধ শেখার মতো সময় সুযোগ হয়তো ওই শিক্ষকের মেলেনি। নৈতিক মূল্যবোধের কিছুটা যদি তার মধ্যে থাকতো তাহলে সে হয়তো আশেপাশের মানুষের কথা শুনে ওই নারীকে সাহায্য করতেন।
ধর্মীয় মূল্যবোধ
মানুষের আচরণে ধর্মবিশ্বাসের প্রভাব ব্যাপক। যখন কোন বস্তুকে সর্বশক্তিমান বা ঐশ্বরিক শক্তির সঙ্গে সর্ম্পকযুক্ত করে মহান হিসেবে বিবেচনা করা যায়, তখনই তাকে বলা হয় ধর্মীয় অভিজ্ঞতা বা আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা। এই জাতীয় অভিজ্ঞতার পরিধি অনেক বিস্তৃত ও উদার।
বস্তুজগতের অভিজ্ঞতা অর্জন করার এই ধরনের ক্ষমতাকে ব্যক্তির চারিত্রিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ব্যক্তির চারিত্রিক বিকাশে সহায়তা করা, বিদ্যালয়ে শিক্ষার একটি প্রধান লক্ষ্য। শিক্ষার্থীরা যখন কতকগুলো মৌলিক সর্বজনীন বিশ্বাসের দ্বারা নিজের আচরণকে সুসামঞ্জস্যপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে তখনই তাদের চারিত্র্যিক বিকাশ সাধন সম্ভব হবে। তাই বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রচেষ্টাই হবে ব্যক্তির মধ্যে ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। এজন্যই শিক্ষাক্ষেত্রে যাতে ব্যক্তির ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ বিকশিত হয় সেদিকে অত্যন্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়। সামাজিক বা নৈতিক মূল্যবোধ না থাকুক, কিন্তু ধর্মীয় মূল্যবোধ অন্তত থাকা উচিত। ধর্মীয় মূল্যবোধ থাকলে হয়তো তিনি ধর্মের ভয়েও এরকম বেপরোয়াভাবে মানুষ খুন করতে পারতেন না।
সড়ক দুর্ঘটনা বা সড়কে খুনের জন্য দায়ী আমরা, আমাদের প্রশাসন। সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ সচেতনতার অভাব। অসতর্কতা ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালানো। যান্ত্রিক ত্রুটিসম্পন্ন গাড়ি রাস্তায় নামানো। গাড়ির ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করা। লাইসেন্সবিহীন ও অদক্ষ ড্রাইভার। ট্রাফিক আইন মেনে না চলা।
সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে প্রয়োজন নিরাপদ সড়ক। সতর্কতার সাথে গাড়ি চালানো। আর দুর্ঘটনারূপী খুন প্রতিরোধের একমাত্র উপায় মূল্যবোধের বিকাশ। এই মূল্যবোধের শিক্ষা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ ও স্বাভাবিক একটি সমাজ পেতে সাহায্য করবে। সব অরাজকতা, অনৈতিকতা ও বর্বরতার অবসান হবে একদিন। বর্বরতার কালো ছায়া ঘুচে গিয়ে উদিত হবে নতুন দিনের সুর্য। আলোকিত হবে আমাদের সমাজ, আমাদের দেশ। বর্বরতার অবসান ঘটিয়ে আমরা ফিরিয়ে আনবো নতুন আলো।