স্বাধীনচেতা নারীরা কেন বেশি সহিংসতার শিকার?
আবহমানকাল ধরে দেশে পুরুষতন্ত্রের বদ্ধমূল ধারণা, নারীরা সবসময় পুরুষের পদতলে থাকবে। এমনকি নারীদের জীবন-জিজ্ঞাসা বিষয়েও তাদের কোনো প্রশ্ন থাকতে পারবে না। তবে, বর্তমানে সেই চিত্র কিছুটা পরিবর্তনের দিকে হাঁটছে নারীরা। যেখানে পুরুষের দাসত্ব কায়েম করার জন্য নারীর ওপর চাপ প্রয়োগ বাড়তে থাকে, সেখানে প্রতিবাদও জেগে ওঠে। সচেতন-শিক্ষিত-স্বাধীনচেতা নারীরা আর মুখ বুজে নীরবে পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম সহ্য করছে না। আর তখনই ঘটছে সংঘর্ষ! হচ্ছে মনোমালিন্য, ভাঙছে সংসার! কিন্তু নারীরা স্বাধীনচেতা হলে কেন তার প্রতি নির্যাতন বেড়ে যাচ্ছে? এর দায় কী নারীর? না কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফল? নারীরা প্রতিনিয়ত কেন সহিংস আচরণের বলি হচ্ছে!
বর্তমান সমাজচিত্র লক্ষ করলেই দেখা যাবে, প্রায় সব স্তরেই নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে নারীদের হার বেশি। নারীরা যোগ্যতা-দক্ষতার দ্বারা সাফল্য অর্জন করছে। নিজেদের বাংলাদেশ ও বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে তারা এখন আর পিছিয়ে নেই। কিন্তু এই পিছিয়ে না থাকাকে কেন্দ্র করে তাদের প্রতি সংহিতাও বাড়ছে! প্রকৃত শিক্ষা গ্রহণের ফলে নারী সমাজ থেকে কুসংস্কার দূর হচ্ছে। তারা নিজের বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে। কখনো কখনো হয়ে উঠছে আপসহীন। ফলে তাকে আরও সংহিস আচরণের শিকার হতে হচ্ছে! একদিকে নারীর এগিয়ে চলা অন্যদিকে পরিবার-সমাজের অবহেলা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে!
শিক্ষিত হয়ে ওঠার পাশাপাশি নারী যখন স্বাবলম্বী হয়েও উঠছে, তখন তারা হয়ে উঠছে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও আত্মসচেতনও। এতে আবহমানকাল ধরে চলে আসা পুরুষতন্ত্রের ‘খবরদারিনীতি’ নিমিষেই তা ধসে যাচ্ছে। নারীরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন হয়ে উঠেছে। নারীর এই সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি বেশিরভাগ সময়ই পুরুষতন্ত্র মেনে নিতে পারছে না! কারণ তারা কখনোই চায় না, নারী নিজের যোগ্য মর্যাদা ফিরে পাক, নিজেদের সম্মান নিয়ে বেঁচে থাক। বাইরের মানুষকে বাদ দিলে ঘরের ভেতরও ন্যায়বোধের চর্চা নেই। বরং স্বামীর চেয়ে স্ত্রীর যোগ্যতা-দক্ষতা বেশি হলে, সেখানেও ঘটছে সহিংসতা!
শিক্ষা-কর্মসংস্থানের সুযোগ নারীকে স্বাবলম্বী হতে যেমন সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে, তেমনি তাকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করেও তুলেছে। ফলে নারী তার প্রতি সহিংস আচরণকে মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আর নারী যখন সচেতনতার প্রকাশ ঘটাচ্ছে, তখনই তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এমনকি তারা যখন যোগ্যতা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে নিজের অধিকার দাবি করছে, সেখানেও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ সম্পত্তি বণ্টনে, চাকরির ক্ষেত্রে নারীর প্রাপ্য অধিকার তাকে দেওয়া হচ্ছে না। নারীরা যখন প্রাচীন রীতিকে আঘাত করছে, তখন একশ্রেণীর মানুষ সেই বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখছে না। নারীর চরিত্রে কালিমা লেপন করে তাকে দমিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে, এসব ক্ষেত্রে নারীদের প্রতি যে কেবল পুরুষরাই সহিংস আচরণ করে এমন নয়, নারীর বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের ধারক কতিপয় নারীও এগিয়ে আসে। বর্তমান সমাজে শাশুড়ি-ননদি থেকে শুরু করে পরিবারের অন্যান্য নারী সদস্যও নারীর প্রতি সহিংস আচরণ করে।
নারীরা সহিংস আচরণের শিকার হয় আরও বেশি, যখন সঙ্গী নির্বাচনে ভুল হয়! নারী ও পুরুষের হৃদয়বৃত্তিক সম্পর্ক না থাকলে সেখানে সহিংসতা ভয়াবহ আকার ধারণ করে। দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় ও সমাজের নানা ট্যাবুর কারণে নারীরা সঙ্গী নির্বাচনে অনেকক্ষেত্রেই নিষ্ক্রিয় থাকছে। তাই ঘর বাঁধার সময় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীর রুচি-পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া হতো না। কিন্তু এখন নারীরা তাদের পছন্দ -অপছন্দকে গুরুত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে মত প্রকাশের একটি স্বাভাবিক রীতি তৈরি হয়ে যাচ্ছে। এতে নারীর আত্মিক বিকাশ সাধন সম্ভব হচ্ছে বটে, কিন্তু এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে তার প্রতি সহিংসতাও বাড়ছে।
নারীর প্রতি সংঘটিত এই সহিংসতা বন্ধে সবার আগে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন আনতে হবে। সবার আগে নারীর স্বাধীনচেতা মনোভাবকে সম্মান করতে হবে। মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষ স্বতন্ত্র। তাই তার রুচি-অভিরুচি আলাদা হবে। নারীর কাজের যথাযথ মূল্যায়ন করতে হবে। একইসঙ্গে মানবিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা বাড়াতে হবে। তাহলে সমাজ থেকে নারীর প্রতি সহিংসতা চিরতরে বিদায় নেবে। আমাদের সমাজ সেই পদক্ষেপের দিকে যেতে কবে প্রস্তুতি নেবে?
অনন্যা/জেএজে