নারী কেন আমৃত্যু ত্যাগ করে যাবে
অনেক ভুক্তভোগী নারী মনে করতে পারেন, তার নারী জনমই তাদের জন্য সবচেয়ে বড় বোঝা। এর কারণও স্পষ্ট। সমাজ নারীকে শুধু নারী হিসেবেই পরিমাপ করে। মানুষ হিসেবে নয়। নারীর পরিমাপের ক্ষেত্রগুলো বারংবার ছোট হয়ে আসে। আমাদের পরিবার ও সমাজে নারীকে যেন খেলার পুতুল মনে করা হয়। ছোটবেলায় যখন কন্যা শিশুর হাতে খেলার উদ্দেশ্যে পুতুল দেওয়া হয়, তখন তাকে বোঝানো হয়, তার জীবনটাও এই পুতুলেরই মতো জড়, নির্জীব, অসাড়। তাকে যত আঘাত করা হোক না কেন, তার মুখে কোনো ভাষা থাকতে পারবে না।
নারী জীবন বড়ই অদ্ভুত। ছোট থেকে জীবনটাকে ত্যাগের নামেই ভাসিয়ে দিয়ে স্বস্তি পেতে থাকে নারী। আসলে তাকে শেখানো হয় তুমি নারী। তোমার ধর্ম সবকিছু মেনে নেওয়া। মানিয়ে নিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করায় তোমার জীবনের প্রকৃত সার্থকতা। যদি একজন নারীর ভালো ঘর, বর না জোটে, তবে নারীকেই অপয়া মনে করা হয়৷ এ সমাজ কিন্তু কখনো কোনো পুরুষকে অপয়া তকমা দেয়নি। আজও নারীই একমাত্র ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে নানান নামে অভিহিত। কী আশ্চর্য অসম বণ্টন দুই বিপরীত লিঙ্গের প্রতি! শুধু নারী হওয়ার কারণে যারা এতটা অস্পৃশ্য, তারই আবার এ সমাজের মূল স্তম্ভ। এই নারীদের হীনদশা কবে কাটবে তা বেশ অনিশ্চিত। কারণ নারী তো ত্যাগেরই অন্য নাম। তার আবার মুক্তি কিসের? তবে কি নারী জীবনের সার্থকতা ত্যাগের মধ্যেই লুকায়িত?
নারী যতদিন অবিবাহিত থাকে ততদিন সম্পূর্ণরূপে বাবা-ভাইয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করে। সব নীতি-নির্ধারণী শক্তি পরিবারের ওপরই ন্যস্ত থাকে। কন্যা সন্তানের শৈশব-কৈশোর-যৌবনে প্রবেশ; সবটাই একটা লুকোচুরির বিষয়। পরিবারও যেন বাইরে প্রকাশ করতে চায় না, তার ঘরে কন্যা সন্তান আছে। কারণ সমাজ তাকে জোরেসোরে ধাক্কা দেবে। সেই ভয়ে পরিবারবর্গও কুণ্ঠাবোধ করে কন্যা সন্তানের স্বাভাবিক বিকাশ ঘটাতে। শতকরা নিরানব্বই ভাগ বা তারও কিঞ্চিৎ বেশি নারীরা যখন জীবনকে উপভোগ করতে চেয়েছে বা নিজের পছন্দানুযায়ী কাজ করতে চেয়েছে, তখন অভিভাবকেরা তাকে সে কাজ থেকে নিবৃত্ত করেছে।
বাবা-মা কন্যা সন্তানকে এটা বুঝিয়েই ক্ষান্ত থাকেন নিজের মতো জীবনযাপন করার বয়স তার এখনো হয়নি। ফলে সে ইচ্ছেমতো জীবনযাপন করতে পারবে না। বিয়ের পর স্বামীর ঘরে গেলেই সে স্বাধীন। সেখানে স্বামীর সঙ্গে যেখানে খুশি ঘুরবে, ফিরবে, যা ইচ্ছা করবে। এককথায় সব শখ-আহ্লাদ পূর্ণ করবে। তখন কেউ তাকে বাধা দেবে না। এই কথাটি শোনেননি বা জানেন না আমাদের সমাজে এমন নারী মেলা ভার। আর এই প্রপঞ্চ চলতে থাকে নারীর জীবনভর।
আবার এই নারীই যখন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে স্বামীর ঘরে প্রবেশ করছে তখন স্বামীর কড়া শাসন। পরিবারের মান-সম্মান সব তার ওপর। শ্বশুর বাড়ির অসম্মান হয় এ ধরনের কোনো কাজ করা যাবে না। তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী চলতে হবে। এতদিন বাপের বাড়ি যা খুশি করেছে কিন্তু এখন তাকে নিয়ম মেনে জীবন পরিচালনা করতে হবে। অনেকে তো শাসিয়ে থাকেন যা করার খুব করে এসেছো আজীবন। এখন বিয়ে হয়ে গেছে তাই কোনোভাবেই আর আগের মতো হুটহাট যা মন চাইলো করলাম, চলবে না।
ভয়, হতাশা, গ্লানি বয়ে আর কতকাল নারী জীবন ধুঁকবে? এবার হোক অবসান। নারী তার আপন বিশ্ব গড়ে তুলুক নিজস্ব পারঙ্গমতায়।
সন্তান হলে তাকে লালন-পালন করা, পরিবারের সবার মঙ্গল কামনাতেই ব্যস্ত হতে হবে। নারীর চোখে আবারও একরাশ অন্ধকার। নারীরা তখন আবারও বুকে স্বপ্ন লালন করে চলে। হয়তো তাহলে সন্তানেরা বড় হলে একটু নিজের আনন্দ, ইচ্ছে মতো সব করতে পারবে। কিন্তু সন্তান যখন বড় হয় একটা সময় পর তার ঘর-সংসার হয়। তখন নারীরা ভাবে, এবার হয়তো তার কাঙ্ক্ষিত চাওয়া পূরণ করতে পারবে। ভালো মতো স্বাধীন, স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করতে পারবে। কিন্তু আবারও শুনতে হয় একই কথা। ছেলে মাকে বোঝাতে থাকে, বয়স অনেক হয়েছে। এখন আর যা ইচ্ছে করা যায় না। যে কয়দিন বাঁচবে ধর্মকর্ম করে যাও। এর মধ্যেই তার সবটা পাওয়া হবে। আর এভাবেই ক্রমান্বয়ে চলে নারীর জীবন।
নারীকে কেউ কখনো জিজ্ঞেস করেন না তার কী চায়? কেমনভাবে ও কেমন জীবনযাপন করলে সে শান্তি পাবে? কারণ আমাদের পরিবার, সমাজ জানেই না নারীও মানুষ। তারও আত্মার ক্লান্তি দূর করা দরকার। ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, সম্মান, শান্তি, মর্যাদা দরকার। ফলে নারীর সঙ্গে চলে প্রহসন। সেই প্রহসনে আজীবন চিতায় জীবন্ত দগ্ধ হতে থাকে নারী। এই দীর্ঘ প্রহসনের যেন কোনোই মুক্তি নেই।
প্রহসনের মুক্তি মেলা সত্যি বড়ই কষ্টকর। কারণ প্রহসনটিকে সমাজ নারীর কোমলতার স্পর্শে রাঙিয়ে দিয়েছে। তার কোমল মনটাকে অধিকার করেছে শৈশব থেকে। তাকে শেখানো হয়েছে তুমি অতি নরম, ভদ্র, সভ্য, কোমলপ্রাণের অধিকারী। তোমার জীবনটাই ত্যাগের জীবন। ফলে সবকিছু ছাড় দেওয়ার মানসিকতা অবশ্যই তোমার থাকতে হবে। পুরুষ রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, বাইরে হাড়ভাঙা খাটুনি করে। তুমি তো কিছুই করো না ধরতে গেলে। তোমাকে তো মাথা ঠাণ্ডা রাখতেই হবে।
সবটা সামাল দিতে হবে। যদি তা না পারো তবে তুমি কেমন নারী! আজন্ম নারীরা শোষিত তার পরিবারের এরূপ কুশিক্ষা দ্বারা। যা নারীকে আত্ম মর্যাদাহীন, মেরুদণ্ডহীন করে তোলে। শুধু ‘হ্যাঁ’তে ‘হ্যাঁ’ মিলিয়ে তার জীবন পার করতে হয়। আজকাল নারীর জীবনে কিছুটা রদবদল এসেছে। নারীরা বাইরে কাজ করছে৷ কিন্তু সেখানেও নতুন তকমা। আগেই বলেছি কাজের ক্ষেত্র অনুযায়ী সমাজ তাকে নতুন নতুন তকমা সেঁটে দেয়।
নারীরা যখন বাইরে কাজ করে তখন বাড়ির পুরুষ সদস্যের বলার ধরন পাল্টে যায়। তারা যে সংসারে মনোযোগ দেয় না, সময় দেয় না, উদাসীন প্রভৃতি বহু মন্তব্য। তাহলে নারীরা কোনদিকে যাবে? ত্যাগেই জীবনের সার্থকতা ভেবে আজন্ম ধুঁকে ধুঁকে মরবে? নাকি নিজের আনন্দ নিয়ে বাঁচতে শুরু করবে?
অধিকার বঞ্চিত করে পরিবার ঠেলে দেয় স্বামীর দিকে, স্বামী ঠেলে দেয় সন্তানের দিকে। এই প্রহসন বন্ধ হোক। নারীকে পোষমানা পাখির মতো বুলি শেখানো বন্ধ হোক। আমাদের পরিবারগুলো কন্যা সন্তানের দিকে মনোনিবেশ করুক। এ ব্যাপারে কন্যা সন্তানের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারেন মা। তিনি নিজেও একজন নারী। তিনি জানেন তার জীবনের অনেক অপ্রাপ্তি। সেই অপ্রাপ্তি কোনোদিন পূরণীয় নয়। ফলে কন্যা সন্তানকে বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক পরিবেশ দিতে চেষ্টা করি।
তার ওপর বোঝা চাপিয়ে দিয়ে নয় বরং তাকে আনন্দের সঙ্গে জীবনকে মোকাবিলা করার শিক্ষা প্রদান করতে চেষ্টা করি। যদি নারীরা জাগে তবেই কিন্তু ভবিষ্যৎ নারীর মুক্তি ঘটতে পারে। ভয়, হতাশা, গ্লানি বয়ে আর কতকাল নারী জীবন ধুঁকবে? এবার হোক অবসান। নারী তার আপন বিশ্ব গড়ে তুলুক নিজস্ব পারঙ্গমতায়।