দূর হোক কর্মস্থলে নারীর অস্বস্তি
সে যুগ হয়েছে বাসি,
যে যুগে পুরুষ দাস ছিলো নাকো, নারীরা আছিলো দাসী।
—কাজী নজরুল ইসলাম
একসময় নারী শুধু অন্দরমহলের বাসিন্দা ছিল। বাইরে কোথাও যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। এমনকি শ্বশুরালয় থেকে পিত্রালয় যেতো রাতে পালকি করে। অন্য লোকের সামনে মুখ দেখানো যেতো না। কিন্তু দিন বদলেছে। নারীও এখন পুরুষের সঙ্গে সমান তালে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে পুরুষের পাশাপাশি অবদান রাখছে নারীরাও। রাজনীতি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, সব ক্ষেত্রেই এখন নারীদের উপস্থিতি।
কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে, যাতায়াত বা অফিসে নারীরা কতটুকু স্বস্তিবোধ করে, তাই আজ প্রশ্ন। হয়রানির শিকার হওয়া এখন নিত্যদিনের ব্যাপার। খবরের কাগজের পাতা ওল্টালে প্রতিদিনই দেখা যায়, কোনো না কোনো নারী শিকার হচ্ছে যৌন-হয়রানি থেকে শুরু করে ধর্ষণের মতো ঘটনার।
পরিবার থেকেও আসে নানা বিপত্তি। নারীরা বাইরে কাজ করবে, এই বিষয়টা অনেক পরিবার মেনে নিতে পারে না। বিয়ের পর অনেক মেয়েই চাকরি ছেড়ে সংসার ধর্মে মন দেয়। আবার যারা কাজ ধরে রাখে, তাদের সম্মুখীন হতে হয় নানা সমস্যার। রাস্তাঘাটে চলাচল করার সময় তারা শিকার হয় নানা হয়রানির। অফিসেও হয়তো পুরুষ সহকর্মীদের কাছ থেকে আসে নানা কটূক্তি। আর এই সব ব্যাপার একজন কর্মজীবী নারীর মন ভেঙে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
অফিসে কাজ করতে যেসব কারণে নারীরা অস্বস্তি বোধ করেন, এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কারণ হলো:
১। পুরুষ সহকর্মীর মাধ্যমে হয়রানি
অফিসে কথার ছলে হয়তো সহকর্মীরা অনেক কথাই বলেন। কিন্তু কথাগুলো যার উদ্দেশে বলা, সে কিভাবে নেবে, তা ভাবার সময় আমাদের কই। কোনো একটা কথাতে কষ্ট পেলেও বলার সুযোগ নেই। আর এভাবে একসময় নারীরা অফিসে কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করা শুরু করে।
২। পিরিয়ড ট্যাবু
পিরিয়ডের সময় নারীরা স্বাভাবিকভাবেই একটু অস্বস্তি বোধ করে। কিন্তু এসময় পুরুষ সহকর্মীদের কটু কথার আঘাতে অস্বস্তি আরো বেড়ে যায়। কাজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না।
৩। সংসার
একজন নারীর কাছে তার সংসার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ঘরের কাজ সামলে তারপর আসে অফিসে। আবার সংসারে একটু আধটু ঝামেলা থাকাটাও স্বাভাবিক। কিন্তু কর্মজীবী নারীদের সংসারের অশান্তি তার কাজের ক্ষেত্রেও প্রতিফলিত হয়। এর এটিও নারীর কাজের ক্ষেত্রে অস্বস্তি বোধের অন্যতম কারণ।
৪। যানবাহনের সমস্যা
যাতায়াতের অসুবিধা একটি বড় কারণ। সাধারণত পাবলিক ট্রান্সপোর্টেই নারীদের যাতায়াত করতে হয়। এর এখানে নারী শিকার হয় যৌনহয়রানির। এর প্রভাব পড়ে কাজে। সারাদিন অস্বস্তিতে কাটে। তাই অফিসে কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করার অন্যতম কারণ হিসেবে ধরা যায় যাতায়াতের অসুবিধা।
স্বাধীনতা পরবর্তী ৫০ বছরে বাংলাদেশে অর্থনীতির পট পরিবর্তনে একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ। এই পাঁচ দশকে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি অর্জনের সফলতায় বড় অবদান রেখেছেন নারীরা।
পরিসংখ্যান বলছে, দেশে বর্তমানে সাড়ে ৬ কোটিরও বেশি নারী ও পুরুষ কর্মজীবী। গড় হার পুরুষ ৭০ শতাংশ ও নারী ৩০ শতাংশ। কৃষি ও তৈরি পোশাক কারখানায় ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকের সংখ্যা বেশি হওয়ার আনুপাতিক হারে নারীর সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে।
জন প্রশাসন ও অন্যান্য চাকরিতে নারী পুরুষের আনুপাতিক হার এখনও ৫০:৫০ হয়নি। দেশে কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়া এবং নারীর কাজের গতি পুরুষের চেয়ে বেশি হওয়ায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের ৫ম অধ্যায়ে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।
এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে নারী কর্মজীবী নেই। জন প্রশাসন, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, বিজ্ঞানী, স্বশস্ত্র বাহিনী, সিভিল এভিয়েশন, পুলিশ, র্যাব, আনসার, স্বাস্থ্য, ব্যাংক বীমা, অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠান, নির্মাণকর্মীসহ বিভিন্ন শাখায় নারীরা কাজ করছেন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ থেকে শুরু করে কর্মচারী পদে নিয়োজিত আছেন তারা।
অর্থনীতির মূলধারার স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেক নারী। অর্থনীতির বৃহত্তর তিনটি বড় খাত কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ছে। দেশের পোশাক শিল্পের ৮০ শতাংশ শ্রমিকই নারী। কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চলে গেল শতকের শেষ দশকেও কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে কম ছিল। কৃষিতে যন্ত্র যুগের দ্রুত আবির্ভাবে নারীর অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে। এর বাইরে কৃষি কাজে প্রায় দেড় কোটি ও শিল্প খাতে অন্তত ৫০ লাখ নারী শ্রমিক রয়েছেন। রাজনৈতিক অঙ্গনেও এগিয়ে যাচ্ছে নারীরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালে দেশে কর্মক্ষেত্রে নারী ছিল মাত্র ৪ শতাংশ। এই হার ১৯৮০ সালের দিকে ৮ শতাংশ ও ২০০০ সালে ২৩ দশমিক ৯ শতাংশে ওঠে। তবে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার ২০১০ সালে বেড়ে ৩৬ শতাংশ হয়। ২০১৩ সালে অবশ্য কিছু কমে ৩৩ দশমিক ৫ শতাংশে নামে।
বিবিএসের সর্বশেষ ২০১৬-১৭ সালের শ্রমশক্তি জরিপে নারী হিস্যা ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে। ওই জরিপ অনুযায়ী, দেশে শ্রমশক্তির আকার ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এরমধ্যে ৬ কোটি ৮ লাখ মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন। মোট শ্রমশক্তিতে ৪ কোটি ২২ লাখ পুরুষ আর নারী ১ কোটি ৮৭ লাখ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়ছে।
আর কর্মক্ষেত্রে নারীর স্বস্তি বোধ নিশ্চিত করাও জরুরি। আশা করি, শিগগিরই নারীরা কর্মক্ষেত্রে থাকবে স্বস্তিতে। দেশ ও দশের উন্নয়নে অংশ নেবে সমানতালে।