বাল্যবিয়ে মুক্ত সমাজ কতদূর
বাংলাদেশে উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক ব্যাধি। যদিও বিগত কয়েক বছর যাবত বাল্যবিয়ে অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু করোনাকালে এই সংকট আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে! কিন্তু কেন কোমলমতি শিশুর জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলার এই প্রতিযোগিতা!
বাল্যবিয়ের প্রধান কারণ দারিদ্র্য। পরিবারের অর্থনৈতিক অসচ্ছলতার কারণে শিশুকন্যাকে বিয়ে দিয়ে দেন অনেক বাবা-মা। সন্তানের জন্য তা কতটা সুখকর হবে—তা নিয়ে তাদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। বরং মাথা থেকে সন্তানের মঙ্গলচিন্তা নামাতে পারলেই নিজেদের ধন্য মনে করেন। বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে অপরিণত প্রেমও অনেকাংশে দায়ী। পরিপূর্ণ বয়সের আগেই সন্তান বিপথে চলে গেলে বাবা-মা তাকে সামাজিক টিকিট নামক ‘বিয়ের’ সনদ ধরিয়ে দেন। ফলে বাবা-মায়ের আত্মসম্মান রক্ষার্থে সন্তানকে অপরিণত বয়সেই ‘বিয়ের বলি’ হতে হয়!
বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ অশিক্ষা ও কুসংস্কার। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে মানুষ ভালো-মন্দের বিভেদ বুঝতে পারে না। ফলে অশিক্ষিত জনগণের মাঝে কুসংস্কার জন্ম নেয়। এর ফলে সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা-মা উদাসীন থাকেন। প্রতিনিয়ত যার শিকার হয় শিশুরা!
বখাটের উৎপাত থেকে কন্যাশিশুকে রক্ষার উপায় হিসেবেও বাবা-মা বাল্যবিয়ের আশ্রয় নেন। অনেক বাবা-মা মনে করেন, বিয়ে না দিলে কন্যা সন্তানকে বখাটেদের উৎপাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে না। ফলে বাবা-মা অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতেই মেয়ে শিশুকে অপরিণত বয়সেই বিয়ে দিয়ে সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন। বাল্যবিয়ের আরও একটি বিশেষ কারণ ধর্মীয় অপব্যাখ্যা। অশিক্ষার সঙ্গে যখন যুক্ত হয় ধর্মীয় গুরুদের উপদেশ। তখন নিরক্ষরতাজনিত কারণে ভালো-মন্দ বিচার করার সক্ষমতা হারিয়ে সন্তানের ভবিষ্যৎ অন্ধকার করে তোলেন অনেকেই।
বর্তমানে কন্যাশিশু এতটাই অনিরাপদ সমাজের দিকে লক্ষ করলেই তা চোখে পড়ে। এমন দিন নেই যে, পত্রিকা খুললে চোখে পড়ে না ধর্ষণের মতো বীভৎস ঘটনা! বাল্যবিয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে এটাও বিশেষভাবে উল্লিখিত। বাবা-মা সন্তানের প্রকৃত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। ফলে বাল্যবিয়ে দিয়ে সহজ সমাধান খোঁজার চেষ্টা করেন।
মেয়েকে উপার্জনে অক্ষম ভাবার কারণেও বাল্যবিবাহ ঘটছে। সন্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে বাবা-মা শঙ্কিত হয়ে ভালো পাত্রের সন্ধান পেলে কোন বাছ-বিচার না করে মেয়েকে অন্ধকারে ঠেলে দিচ্ছেন। তারা মনে করেন, হয়তো সন্তানটিকে আলোর মুখ দেখাচ্ছেন। কিন্তু বাঘের মুখ থেকে বাঁচাতে তারা কুমিরের আশ্রয় নিচ্ছেন! যৌনশিক্ষার অভাবের ফলেও বাল্যবিয়ে ঘটছে। প্রকৃত শিক্ষার অভাবে শরীরবৃত্তীয় চাহিদা তাদের মনে কৌতূহলের জন্ম দিচ্ছে। ফলে বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক অপরাধ ঘটছে।
বাল্যবিবাহের কুফল মারাত্মক। পারিবারিক-সামাজিক; সব ক্ষেত্রেই বাল্যবিয়ের কারণে কন্যাশিশু নানামুখী সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বাল্যবিয়ের ফলে প্রথমত কন্যাশিশুদের স্বাস্থ্যহানি ঘটছে, দ্বিতীয়ত তারা মানসিক স্থিরতা হারাচ্ছে। যা দীর্ঘ-স্থায়ীভাবে তাদেরকে ভোগাচ্ছে! এছাড়া ঘটছে যৌতুকের মতো সামাজিক অপরাধের নিত্যচর্চা! বাবা-মা যখন তার অপরিণত সন্তানকে পাত্রস্থ করার চেষ্টা করছেন, তখনই তাকে কিছু অনৈতিক চর্চা করতে হচ্ছে! যার ফলস্বরূপ যৌতুক প্রথাকেও পুরোপুরি নির্মূল করা যাচ্ছে না। ফলে একটি সমস্যা আরও একটি সমস্যা সৃষ্টি হতে সাহায্য করছে! বাল্যবিবাহের কারণে অকালে ঝরে পড়ছে কন্যাশিশু। যে সমস্যা সামাজিকভাবে আরও জাতিকে ধ্বংসমুখী করে তুলছে!
বাল্যবিয়ের মতো সামাজিক অপরাধকে রুখতে এখনই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নতুবা সামাজিক অধঃপতনকে কিছুতেই ঠেকানো যাবে না। এক্ষেত্রে প্রথমেই ঘরে-বাইরে মেয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। অভিভাবক ও শিক্ষকদের নিজ নিজ অবস্থানকে দৃঢ় করে তুলতে হবে। যেকোনো পরিস্থিতিতে কন্যাশিশুকে আগলে রাখার মানসিকতা গ্রহণ করতে হবে। পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমেও বাল্যবিয়েকে অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। এছাড়া প্রেম-বিয়ে সম্পর্কে সন্তানকে সুশিক্ষা দিতে হবে—যেন কৌতূহল বশে ভুল না করে ফেলে! প্রচলতি আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আইনের প্রয়োগ নিশ্চিত করার জন্য কন্যাসন্তানের বয়স বাড়ানোর ক্ষেত্রে ভুয়া জন্মসনদ তৈরিতে জড়িতের বিরুদ্ধে আগে ব্যবস্থা নিতে হবে।
এছাড়া ভুয়া জন্মসনদ প্রদানকারীর কঠিন থেকে কঠিনতর শাস্তি কার্যকর করতে হবে। তাহলেই বাল্যবিয়ে নির্মূল করা সম্ভব। সমাজে ধর্মীয় নেতা ও ব্যাখ্যাকারদের মতের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তাই মসজিদ-মন্দির-গির্জার-প্যাগোডার মতো উপাসনালয়গুলোতে বাল্যবিয়ের কুফল সম্পর্কে সচেতনতামূলক প্রচারণা চালাতে হবে। সর্বোপরি বাল্যবিয়ে বিরোধী প্রচারণা, সভা-সেমিনার, মতবিনিময়ের মাধ্যমে সামাজিক আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তুলতে হবে। মানুষের ভেতর বাল্যবিয়ে বিরোধী মনোভাব গড়ে তুলতে পারলে একদিন সমাজ থেকে এই ব্যাধি চিরতরে দূর হবে। কিন্তু সেদিন কতদূর?
অনন্যা/জেএজে