নারী কেন আজও উপঢৌকন?
আধুনিকতার যুগে বসবাসসূত্রে আমরা জাতি হিসেবে অনেক এগিয়ে গেছি বলেই ধরে নেওয়া হয়। প্রাচীনকাল থেকেই নারী পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বেড়াজালে বন্দি। বাবা-ভাই বা স্বামীর দ্বারাই সমাজ-সংসারে নারীর পরিচয়। আজও তার পরিবর্তন সূচিত হয়নি। আজও নারী সেই একই অলঙ্করণে নিজেকে সাজায়।
আধুনিক যুগে এসে নারীরা তাদের সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে, কথা বলছে। কিন্তু সেখানেও থেকে গেছে ধোঁয়াশা। পুরুষচালিত সমাজে নারীকে বশীভূত করার এক সুকৌশল চক্রান্ত চলছে। কারণ সামাজিকভাবে নারীরা এখন নিজেদের অধিকার নিয়ে কথা বলছে। সমানভাবে সর্বত্র অংশগ্রহণের প্রতি নজর দিচ্ছে। ফলে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ নারীকে নতুনভাবে চালিত করতে চেষ্টা করছে। মহাভারতের যুগে দ্রৌপদীর স্বয়ংবর সভায় লক্ষ্যভেদের মাধ্যমে পাত্র নির্বাচন এবং বিবাহ হয়। এখানে নারীর ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রকাশ পায়নি। ঠিক তেমনই কৌরবদের প্রহসনমূলক পাশাখেলার বাজিও হয় দ্রৌপদী। এই নারীর উৎকোচ বা বাজিতে পরিণত হওয়া নতুন নয়।
প্রাক-ব্রিটিশ ভারতে নারীর জন্য প্রচলন ছিল সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা। সেন আমলে কুলীন নারীকে তুলে দেওয়া হতো মৃত্যুপন্ন, বহুবিবাহসম্পন্ন কুলীন পাত্রের হাতে, রাজকন্যাদের বিয়ের ক্ষেত্রে মানা হতো রাজমর্যাদা, একজন রাজকন্যাকে পতিরূপে রাজাকেই গ্রহণ করতে হতো। এভাবে সর্বত্রই নারীকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে৷
নারীরা আজ সেই যুগের পরিত্রাণ ঘটাতে পেরেছে বলেই সাধারণ্যে বিশ্বাস। তবে প্রদীপের নিচের অন্ধকার যে আজও শেষ হয়নি। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে এমন অসংখ্য নজির সামনে দাঁড় করানো যাবে। নারীকে পিছিয়ে রাখার এক কপর্দক চেষ্টা সমাজে আজও বিরাজমান। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এই চেষ্টায় ধরা দিচ্ছে নারীরা। তারা হয়ে উঠেছে পুরুষের ভোগের ও কৌশলের শিকার। নারীরা তার শরীরকে পুঁজি করে উচ্চতায় চড়ার চেষ্টায় বিকিয়ে দিচ্ছে সম্ভ্রম।
সমাজের প্রচলিত ধারা অনুযায়ী চলে আসছে উৎকোচ বা উপঢৌকন। আর পূর্বপুরুষের ধারাবাহিকতায় উৎকোচ এখন অনেকটা রাখ ঢাকবিহীনভাবেই চলছে। আগে যদিও উৎকোচ দেওয়া হতো টাকা, বাড়ি, গাড়ি, বহুমূল্য আসবাবপত্র, দামী গয়না, টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিংমেশিন, পানীয়, রেস্তোরা- পানশালায় আর্কষণীয় খাদ্য প্রভৃতি। যুগের চাহিদায় আজকে তার পরিবর্তন ঘটেছে। এখন এর বদলে উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হচ্ছে নারীকে। কথাটা শুনলে প্রথমেই ভিরমি খেতে হয়। এইবাজার দরে নারী বিকচ্ছে তার শরীর নিয়ে।
বহুমূল্যের ফ্লাট, প্লট, দামি আসবাবপত্রের সঙ্গে তুলে দেওয়া হচ্ছে নারীকে। সেখানে নারী ডিলে পরিণত হচ্ছে। গ্রহীতার রুচি অনুযায়ী নারীকে গ্রহণ করছে তারা। কেউ ১৪-১৮ কিশোরীর প্রতি ঝুঁকছে, কেউবা ২২-২৫ তরুণীর প্রতি। আবার কাস্টমারের রুচি অনুযায়ী ৩০-৩৫ পর্যন্ত বিবাহিত নারীকে কাজে লাগাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠানগুলো। অতি আধুনিকতার বুলি আওড়ানো নারী নিজের শরীরকে বিনিয়োগ করছে অর্থ উপার্জনে। সমাজের মাঝে গজিয়ে ওঠা এই বিকৃত মানসিকতা, কামুকদের যৌনক্ষুধা নিবারণে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে।
আজকাল ছোট থেকে বড় সব প্রোডাক্টের এডভারটাইমেন্টে ব্যবহার করা হচ্ছে নারীকে। পুরুষের একটি গেঞ্জির এড দিতে হলেও সেখানে যৌন আবেদনময়ী হিসেবে নারীকে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিশ্ব এখন কর্পোরেট বাণিজ্যে ছেয়ে গেছে। আর তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ঘটছে নারীর সম্ভ্রমহানি। সামনের দিকে নারীবাদীরা স্লোগান, ব্যানার, প্লা কার্ড নিয়ে নারীদের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত অন্যদিকে এই নারীরাই অর্থ, ভোগ, যৌনতার কামনায় নিজেদের বিকিয়ে দিচ্ছে। সমাজের অগ্রগতি কোনদিকে ঘটছে?
সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ভারতীয় একটি সিনেমা লাল সিং চাড্ডা সিনেমায় বিষয়টি একটু দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে নেপথ্যে। লালসিং ভোলাভালা সহজ-সরল, বুদ্ধির প্রাগসরতা কম। একসময় তার তৈরি পুরুষের গেঞ্জির ব্র্যান্ড কিছুতেই বাজারে কাটতি হচ্ছে না। কিন্তু একই ব্রাণ্ড, একই কোয়ালিটি যখন কোনো নারীর নামে বাজারে প্রবেশ করছে তখন ধীরে ধীরে বাজারে চাহিদা বাড়ছে। নারীকে পুঁজি করে, নারীর শরীরকে পুঁজি করে এ সমাজ প্রতিনিয়ত নারীকে পণ্যে পরিণত করেছে। নারীও সমানতালে অতি আধুনিকতার ছোঁয়া নিয়ে পুরুষকে টেক্কা দিতে ধসের মুখোমুখি হচ্ছে। এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নতুন কৌশল। সেই ফাঁদে নারীরা আজ বন্দি।
নারীর নতুন নামকরণ হয়েছে কলগার্ল। যারা পয়সার বিনিময়ে পুরুষের যৌনবাসনা, কুপ্রবৃত্তি, তাড়নাকে নিবারিত করছে। এক্ষেত্রে বলা চলে সাধারণ ‘পতিতা’, ‘বারঙ্গনাদের মতো অসহায় হয়ে নয় বরং এই নারীরা সমাজে তাদের পরিচয় গ্রহণ করতেই ভোগ্যপণ্যে পরিণত হচ্ছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থী, গৃহিণী নারী, বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত নারী প্রভৃতি নারীদের টার্গেট করে তাদের জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে এসব কাজের সঙ্গে। মোটা অঙ্কের টাকায় ভরিয়ে দেওয়া হচ্ছে তাদের। সমাজের অগোচরে ঘটে চলেছে বিধায় নারীদের সম্মানহানি ঘটছে না। কিন্তু আসলে কী সত্যিই নারী সমাজের ধ্বংস হচ্ছে না? সমাজের রন্ধ্রে নতুনরূপে নারীকে শোষণের চিত্র চোখে পড়ছে না সুশীল সমাজের? নারীকে পণ্য হিসেবেই কি ব্যবহৃত হচ্ছে না? কী জবাব আমাদের!
নারীরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে। জীবন পরিচালনা সম্পর্কে সচেতন হচ্ছে কিন্তু অন্তরালে চলছে নারীর সর্বস্ব লুটপাট। নারীকে গৃহের বাইরে এসে আবারও শোষণের শিকার হতে হচ্ছে। এই সমাজের কুচক্রী মনোভাব নারীদের ধ্বংসাবশেষে পরিণত করছে। এখানে একমাত্র নারীরাই পারে তাদের মর্যাদা রক্ষা করতে। পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার বলি না হয়ে আত্মসম্মান নিয়ে বাঁচতে। কেউবা চাকরিতে পদোন্নতি চেয়ে সম্ভ্রম বিকোচ্ছে, কেউবা ভোগ্যপণ্য হচ্ছে টাকার কাছে, জশের কাছে। কিন্তু নারীর প্রতি শোষণমূলক মনোভাব তো কমে আসছে না। নারীর অধিকার রক্ষায় এত আলোচনা, সমালোচনা, মিটিং, মিছিল চলছে সেখানে ইঁদুর গর্ত করে ঠিকই মনিবের খাদ্য লুট করেই চলেছে। এই ইঁদুর আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। যারা সমাজকে দংশন করছে প্রতিনিয়ত। নারী নিজের মর্যাদা বুঝুক।
সম্মান-শ্রদ্ধা-আত্মমর্যাদা সম্পর্কে সচেতন হোক। দিনের শেষে যাতে আপন আলোয় মুখ তুলে দাঁড়াতে পারে সেই প্রতিজ্ঞা ধ্বনিত হোক নারীর মননে। নারীকে স্রষ্টা প্রাণশক্তি দিয়েছে। নারী হলো প্রকৃতি। সে সমাজের প্রবাহমান ধারা। সমাজ বিকাশের অন্যতম স্তম্ভ। ফলে কবিগুরুর আক্ষেপ যেন নারী ভাঙতে পারে তার যোগ্যতায়, দক্ষতায়। কবিগুরু বলেছিলেন, নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবার কেহ নাহি দেবে অধিকার? এই অধিকার নিজেকে সঞ্চয় করতে হবে। কেউ পথ দেয় না পথ পথিকই সৃষ্টি করে। নারীকে বিপথে নয় বরং সুপথে আপন ভাগ্য রচনা করতে হবে। যার প্রতিটি পাতায় আলোকোজ্জ্বল হবে। জেগে উঠুক নারী। অত্যাচার- নিপীড়নকে বুঝতে শিখুন। তুলে ধরুক আপন মহিমার মহত্তম বাণী।