কিশোরীদের মানসিক চাপ: সচেতন হওয়া জরুরি
বাংলাদেশে ১৩-১৯ বছর বয়সী শহুরে কিশোর-কিশোরীর ৬০ শতাংশেরও বেশি মানসিক চাপের শিকার। মানসিক চাপের মুখে তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ঝুঁকি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নাগরিক জীবনে সব বাবা-মা সন্তানের পড়াশোনার দিকে বিশেষ মনোযোগ দিলেও তাদের মানসিক সুস্থতা নিয়ে একেবারেই উদাসীন।
শহুরে জীবনে ছেলে-মেয়েরা খেলার জন্য যথোপযুক্ত মাঠ পায় না। এমনকি তাদের কায়িক পরিশ্রম হবে এমন কোনো কাজও তারা করে না। ফলে স্কুলের বাইরে অতিরিক্ত সময়টা তারা ঘরে বসেই কাটাতে অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে কিশোরদের জন্য বাইরের পরিবেশ কিছুটা নিরাপদ হলেও কিশোরীদের ক্ষেত্রে নয়। ফলে স্কুলে নিয়ে আনা-নেওয়া পর্যন্ত বাবা-মা বা বাড়ির অভিভাবকেরা করে থাকেন। কিন্তু এই রুটিন বেইজড জীবনযাপন করতে গিয়ে কিশোরীদের জীবনটা একঘেয়ে, বিষাদময়, হতাশাগ্রস্ত, চাপযুক্ত হয়ে পড়ছে। যার ভারে দিন দিন আত্মহত্যার মতো ঘটনাগুলো বেড়েই চলেছে।
একটা মেয়ের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় কিশোরী বয়স। এই বয়সে কিশোরীরা পরিপূর্ণ নারীরূপে গড়ে উঠতে প্রথম ধাপে পা দেয়। তবে তাদের এ সময়টা শুধু যে শারীরিকভাবে নানাবাধা বিপত্তি আসে না বরং এই সময়কালে ছাত্র জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় পার করে। ভবিষ্যৎ জীবনের ভিত্তি তৈরি হয়। ফলে শারীরিক, মানসিক উভয় ক্ষেত্রে চাপ বাড়তে থাকে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ তাদের গ্রহণ করতে হয়। আর ভবিষ্যৎ বীজ বপন করতে গিয়ে কিশোরীরা হঠাৎ করে এত চাপ সামলে উঠতে হিমশিম খায়। যার ফলে এসময় তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল, সাহায্যপরায়ণ মনোভাব নিয়ে অভিভাবক, শিক্ষক, সমাজকে এগিয়ে আসতে হবে।
সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘আঠারো বয়স কী দুঃসহ / স্পর্ধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি / আঠারো বছর বয়সেই অহরহ / বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।’ সবকিছু মোকাবিলা করার বয়স কিশোর ও তরুণ বয়সে। ফলে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পার করতে হয় কিশোরীদেরও। কিন্তু সে অনুযায়ী পরিবার- পরিজন-স্কুল-কলেজ শিক্ষকদের সহয়তা, মনোবল, সহানুভূতি অর্জন করে না। অনেকক্ষেত্রে এই বয়সী কিশোর-কিশোরীদের অভিভাবকেরা তাদের অভিজ্ঞতা দিয়ে বিচার করে বসেন।
সেই বিচারের কাঠগড়ায় সন্তানকে অপরাধী করে তোলেন। কিন্তু বিশেষভাবে বয়সটাও বিবেচনাযোগ্য। এই সময়কালে কিশোর -কিশোরীরা খুব বেশি আবেগপ্রবণ। বাস্তবতার জ্ঞান সম্পর্কে তারা উদাসীন। সবকিছু ইচ্ছে মতো করা যায়, পাওয়া যায় এমন একটি ধ্যান- ধারণা তারা পোষণ করে। অনেকটা রূপকথার দেশেই তারা বিরাজ করে। ফলে কিশোরীদের মানসিকতাকে না বুঝে কেউ যদি অযথা তাদের প্রতি অবজ্ঞা, অবহেলা করে তাতে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা বেশি।
কিশোর-কিশোরীদের প্রতি সহানুভূতিশীল, দায়িত্বশীল না হলে যেকোনো বাজে সঙ্গে তাদের জীবন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। ফলে পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের কিশোর-কিশোরীদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করা। তাদের স্বপ্ন ও বাস্তবতা সম্পর্কে বোধগম্য করে তোলা। পড়াশোনার পাশাপাশি পছন্দানুযায়ী কাজে অভ্যস্ত করে তোলা। মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় ব্যায়াম, ভালো বই পড়া, মুভি দেখা, ছবি আঁকা, সাইক্লিং, গান, আবৃত্তি, ডিবেটিং, নৃত্য বিভিন্ন কাজে কিশোরীদের অন্তর্ভুক্ত করে। বাড়ির কাজেও সহোযোগিতা করার প্রতি প্রেষণা সৃষ্টি করতে হবে। যাতে অলস অবসরে হতাশা, বিষাদ ঘিরে না বসে। কর্মচঞ্চল জীবন কিশোরীদের মুখর করে তুলবে। তাহলে পড়াশোনার অতিরিক্ত চাপ, একটা ভালো রেজাল্ট, কলেজে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির চাপ, শারীরিক পরিবর্তনের ফলে নিজের প্রতি বিশেষ যত্ন প্রভৃতি বিষয় নিয়ে যেন কিশোরীরা ভেঙে না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
বর্তমানে কিশোর-কিশোরী সবচেয়ে বেশি মানসিক চাপে আছে পড়াশোনা নিয়ে। এছাড়া ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা, স্কুলের পারফর্মেন্স, আবেগাপ্লুত রোমান্টিক সম্পর্কে জড়িয়ে মানসিক চাপে পড়ে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তিতে ঘাটতি হলেই তাদের জীবন নিমিষেই অর্থহীন মনে হয়। এই আবেগকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে না বেশিরভাগক্ষেত্রেই। তবে পরিবার-পরিজন-শিক্ষকদের ঐকান্তিক সহোযোগিতায় কিশোরীদের জীবনটাকে উপভোগ্য করে তুলত পারন তারা। বর্তমানে ৯০শতাংশ কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোনসহ নানারকম ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ওপর বেশি নির্ভরশীল যার দরুণ তাদের মস্তিষ্ক সবসময় একটা অস্থিতিশীল উত্তেজনা কাজ করতে থাকে। বাস্তব জগৎ থেকে তারা দূরে সরে যায়। কল্পনার সুন্দর জগতে নিজেকে দেখতে ভালোবাসে। যখন বাস্তবতায় সেই আকাঙ্ক্ষা প্রাপ্ত হয় না তখন জীবন অর্থহীন মনে হচ্ছে তাদের কাছে।
ফলে বর্তমান কিশোর-কিশোরীদের সঠিক পথ দেখাতে একমাত্র অভিভাবক, শিক্ষকদের তাদের বয়সের পর্যায়ে গিয়ে বুঝতে হবে। তাদের প্রতি বাড়তি মানসিক চাপ না দিয়ে তারা যতটুকু গ্রহণ করতে পারছে সেটুকুই প্রদান করতে হবে। কথায় আছে, বিষও হজম হয় যদি তা পর্যায়ক্রমে আসে। একবারে পৃথিবীর সব চাহিদা, প্রত্যশা পূরণ করা কোন মানুষের পক্ষেই সম্ভব নয়। অভিভাবকদের সেই জ্ঞানটুকু থাকতে হবে। কিশোরীরা ঘরে আবদ্ধ হয়েই থাকে। বাইরের জগতে তাদের যোগাযোগ নেই বললেই চলে। সেই ঘরেও যদি তাকে মানসিক শান্তি না দেওয়া হয় তাহলে চাপ বাড়বে স্বাভাবিক। তাই কিশোরীদের মানসিক চাপ কমাতে পরিবার এবং শিক্ষকদের ভূমিকা অপরিসীম।