দেনমোহর হিসেবে বই: যা বললেন তারা
আর্নেস্ট হেমিংওয়ে বলেছেন, ‘বইয়ের মতো এত বিশ্বস্ত বন্ধু আর নেই।’ অর্থাৎ মানব জীবনের অন্যতম বিশ্বস্ত সঙ্গী বই। আর মানব জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে বইয়ের মতো এত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা কেউই রাখতে পারে না। একটি ভালো বই একশ বন্ধুর চেয়ে শ্রেয়। আর বইয়ের সূচনা যদি হয় শুভ কাজের সাক্ষী হয়ে, তাহলে বিষয়টি মন্দ নয়। বইয়ের অনবদ্য ভূমিকাকে এবার জীবন চলার পথে নতুনভাবে সঙ্গী করলেন কয়েকদিন আগে বগুড়ার সান্ত্বনা-নিখিল নওশাদ। তাদের পথ অনুসরণ করে সম্প্রতি ইবির ছাত্রী সুমাইয়া ঢাবির ছাত্র রুহুল মিথুন ১০১ বইকে দেনমোহর নির্ধারণ করে বিয়ে করেছেন।
দেনমোহর নারীর ইসলামিক ও আইনি অধিকার। নারীর নিরাপত্তা বিধানের লক্ষ্যেই দেনমোহর দেওয়া হয়। যদিও নারীরা ইচ্ছে করলে স্বামীকে মাফ করে দিতে পারে। তবে সময়ের সঙ্গে মানুষের চাহিদা, রুচি, ইচ্ছের পরিবর্তন ঘটছে। আগের মতো নারীরা এখন আর শুধু পুরুষের ওপর নির্ভর করেই জীবন নির্বাহ করে না। ফলে দেনমোহরের ক্ষেত্রেও নতুন ধারার সূচনা করেছেন দুই দম্পতি। বিষয়টিকে গুণীজনেরা কিভাবে মূল্যায়ন করছেন সে বিষয়ে অনন্যা টিম কথা বলেছে কয়েকজন নারীর সঙ্গে।
কবি তানিয়া হাসান বলেন, ‘১০১ টি বই দেনমোহরের খবরটি আমার জীবনে শোনা অন্যতম জমকালো ঘটনা। বইয়ের চেয়ে মূল্যবান পৃথিবীতে আর কিছু নয়, এমন মতবাদে একমত পোষণ করেননি এমন কোনো মনীষী নেই। তবে, এই মতবাদের বাস্তব স্বীকৃতি দিলেন প্রথমে সান্ত্বনা-নিখিল। তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে এবার একই পথে হাঁটলেন সুমাইয়া-মিথুন। এই দুই দম্পতিকে অভিনন্দন জানাই।’
কবি খাদিজা ইভ বলেন, ‘দেনমোহর নারীর অধিকার, অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। সেই সঙ্গে স্ত্রীর হক, যা মাফ চাওয়া বা করার বিষয় নয়, আদায় করা বাধ্যতামূলক। মোহরানা বিয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগে সব সমাজে নির্যাতিত, নিষ্পেষিত ছিল নারী। মূর্খ যুগে আরবেও ছিল নারী অত্যন্ত নিম্নমানের পণ্যসামগ্রী। ইসলাম নারীকে দিয়েছে যথাযোগ্য অধিকার। দেনমোহরের সাহায্যে নারীকে দিয়েছে সম্মানজনক মর্যাদা ও স্থায়ীত্বের নিশ্চয়তা। ’
নারীদের দেনমোহর হিসেবে টাকা কিংবা স্বর্ণ দিতে হয় উল্লেখ করে খাদিজা আরও বলেন, ‘নারী চাইলে ক্ষমাও করে দিতে পারেন। পুরোটায় নির্ভর করে নারীর ওপর। এখন নারী যদি নিজে থেকেই দেনমোহর হিসেবে বই উপহার দাবি করেন, তাহলে বিষয়টি নেগেটিভভাবে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। কেননা পূর্বে নারীরা ছিল অশিক্ষিত। তালাকপ্রাপ্তা নারীরের স্বামী ছাড়া জীবনযাপন ছিল কষ্টের ব্যাপার।’ তিনি বলেন, ‘দেনমোহর তখন চলার পথের একটা বড় অবলম্বন ছিল। কিন্তু আধুনিক যুগে এসে নারী তাদের অবস্থান নিয়ে অনেক সচেতন। শিক্ষাক্ষেত্র থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত সবজায়গায় তাদেরকে ঈর্ষণীয় অবস্থানে ধরে রেখেছে। তারা যদি দেনমোহরের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে টাকার বিনিময়ে বই উপহার চান, সেই চাওয়াটা কোনো দিক থেকেই খারাপ ভাবে দেখা উচিত নয়। বগুড়ার স্বান্তনা-নিখিল থেকে শুরু করে সুমাইয়া-রুহুল মিথুন যে ১০১টি বই দেনমোহর হিসেবে ধার্য করার ডিসিশন নিয়েছেন, সেটি পুরোপুরি পজিটিভ ও সমীচীনও।’
ফরিদপুরের ভাংগার ঘারুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও কথাশিল্পী শারমিনর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি সাধুবাদযোগ্য। এই বছরই প্রথমে শুনেছি বগুড়ায় কবি নিখিল নওশাদ ও সান্ত্বনা ১০১টি পছন্দের বইকে দেনমোহর ধরে বিয়ে করেছেন। টাকার পরিবর্তে দেনমোহর হিসেবে বইয়ের দাবি অভিনব ও অনুকরণযোগ্য বলে মনে করি। নিখিল-সান্ত্বনার পথ ধরে এবার সুমাইয়া-মিথুনও দেনমোহর হিসেবে ১০১টি বই নির্বাচন করেছেন। বিষয়টি আনন্দের। তাদের অভিবাদন জানাই।’
রেডিও ধ্বনি’র আরজে নুরজাহান নুর বলেন, ‘বিয়ের দেনমোহর হিসেবে ১০১টি বই! শুনতে সত্যিই অবিশ্বাস্য মনে হয়। কিন্তু যারা সাহিত্ প্রেমী, তারা বিষয়টি শুনে খুশি হবেন। প্রেমের সঙ্গে সাহিত্য ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সাহিত্যের সব শাখাতেই প্রেমের বিচরণ। তাহলে প্রেমে সাহিত্য কেন নয়? প্রেমিকাকে যদি কবিতা শোনানো যায়, তাহলে বিয়ের দেনমোহর হিসেবে বই দেওয়া যাবে না কেন? সম্প্রতি ১০১টি বই দেনমোহর হিসেবে দিয়ে বিয়ে করলেন প্রথমে বগুড়ার কবি নিখিল নওশাদ ও সান্ত্বনা। এরপর সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিথুন ও ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সুমাইয়াও ১০১টি বইকে দেনমোহর নির্ধারণ করে বিয়ে করলেন। বিষয়টি অবশ্যই ইতিবাচক। বাংলা সাহিত্য বেঁচে থাকুক প্রেম ভালোবাসায়।’