আজও কেন যৌতুকের বলি হচ্ছে নারীরা?
একসময় যৌতুক প্রথা নিয়ে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হলেও বর্তমানে বিষয়টি নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। তাহলে বলাই চলে সমাজের এই কুপ্রথা থেকে চিরতরে মুক্তি মিলেছে। কিন্তু সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আজও যৌতুক বিদ্যমান তা প্রত্যেকেই জানেন। এটা এখন অনেকটা ওপেন সিক্রেটের মতো। মুখে ফুটে কেউ বলে, আবার কেউবা চুপচাপ থাকলেও যৌতুক নেওয়ার জন্য প্রেশার সৃষ্টি করেন। এই বিষয়টির আবার বেশ কয়েকটি নামও সমাজে প্রচলিত হয়েছে।
দুজন নারী-পুরুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর মেয়ের পরিবার থেকে উপঢৌকন দেওয়া। মেয়ে জামাইকে খুশি হয়ে মোটরসাইকেল, ঘরের আসবাবপত্র, টাকা-পয়সা দিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করে দেওয়া, স্বাবলম্বী করার দায়ভার গ্রহণ করার মতো নানারকম ফন্দি-ফিকির সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। তবে উপঢৌকন দেওয়ার নামকরণে শব্দটা পাল্টাতে পারলেও অপরাধটা থেকেই যায়।
তবে এই প্রথা এতটাই মানুষকে ঘিরে রেখেছে যে, পাত্রের পরিবারগুলো এ থেকে কোনমতেই বের হতে পারেননি। এখনও অঞ্চলভেদে কিছু কিছু জায়গায় যৌতুক প্রথার প্রভাব এতটাই বেশি যে সেখানে কন্যা জন্মগ্রহণ করলেই বাবা-মায়ের মাথায় হাত পড়ে। তারা সন্তানকে পরিপূর্ণ মানুষরূপে গড়ে তোলার আগে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা কিভাবে তার কন্যাকে পাত্রস্থ করবেন সে বিষয়ে তটস্থ থাকেন।
উত্তরাঞ্চলে এই প্রথা প্রকট হলেও সারাদেশেই যৌতুকের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। সাধারণভাবে পাত্রের পরিবার ধরেই নেন, তারা যদি যৌতুকের কথা মুখে উচ্চারণ নাও করেন তাও বিয়ের পর মেয়েকে বাপের বাড়ি থেকে টাকা, অলঙ্কার, আসবাবপত্র, দৈনন্দিন ব্যাবহার্য তৈজসপত্র নানাবিধ উপকরণ গৃহে প্রবেশ করবে। প্রকাশ্যে, লুকিয়ে, সমস্যা সৃষ্টি করে, প্রেশার দিয়ে যেমন করেই হোক না কেন সমাজে আজও যৌতুকের রমরমা পসরা সাজিয়ে আছেন পাত্রপক্ষ। নারীরা কবে এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে?
একজন পুত্র সন্তানকে সঠিকভাবে মানুষ করে তোলার জন্য বাবা-মা যতটা সাধনা করেন কন্যার ক্ষেত্রে ঠিক ততটা করেন না। এই বিষয়টিও সবার জানা। তবে এর নেপথ্য কারণ কন্যাটিকে বিয়ে দিতে হবে। একটা বয়সের পর তার পরিবার হবে অন্য কেউ ফলে পিতা-মা অযথা ইনভেস্ট করতে চান না। তারা জানেন কন্যাকে যতই মানুষের মতো মানুষ করুন না কেন, বিয়ের সময় মেয়েকে পার করতে হলে যৌতুক প্রযোজ্য। ফলে তারা কন্যার জন্য যেটা খরচ করতেন সেই অর্থ বা সম্পত্তি জমা করেন।
এতে কন্যার বিয়ের সময় দায়গ্রস্ত পিতার কাঁধে যৌতুকের ভারটা কিছুটা কমে। বিষয়টির সাদামাটা হিসাবে হয়তো পিতার দিকে ঠিক কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী নিজে। একে তো যৌতুক দেওয়া অন্যায়-অপরাধ। তারওপর একবার দিয়ে পাত্রপক্ষের আকাঙ্ক্ষাটা আরও চতুর্গুণ বাড়িয়ে দেন। ফলে যখনই তারা কোন সমস্যায় পড়েন বাড়ির বউকে প্রেশার দিতে শুরু করেন। মনে হয় বিয়ে করে পরিবারগুলো স্ত্রী নয় বরং একটা টাকার মেশিন বাড়িতে স্থাপন করেছেন।
যৌতুক দানের ফলে দুজনের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা -সম্মান কমে যায়। নারীর দিক থেকে মনের অজান্তেই জন্মে অসম্মানের পাহাড়। কারণ কোন নারীই চান না তার নিজের পরিবারকে কষ্টে দেখতে। ২০- ৩০ বছর যেই বাবা-মা কোলে পিঠে করে লালন-পালন করেন তাদের ঘরে সিঁদ কেটে অন্যের ঘরে আলো আনতে, কোনো নারীই চান না এটা হলফ করে বলা চলে। তবে আজকের দিনেও নারীরা এবং তার পরিবার বাধ্য হন। বাবা-মা চান না তার সন্তানটিকে কষ্ট, অসম্মানের ভাগি করতে।
ফলে নিজেদের সামর্থ্য থাক বা না থাক তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। আর এর মধ্যে তারা জেনে বা না জেনে আবারও অন্যায় অপরাধকে প্রশ্রয় দেন। আজকের নারীরা বেশ সচেতন। তারা যৌতুককে মন থেকে ঘৃণা করলেও পাত্রপক্ষের খুশি করতে উপঢৌকন দেন। এর মধ্যে নানবিধ উপকরণই থাকে। আগেই বলেছি ওপেন সিক্রেট আজকে যৌতুক প্রথা। নামকরণ পাল্টেছে কিন্তু প্রথা নয়।
আজকাল ডির্ভোসের হার বেড়েছে। বলা হচ্ছে নারীদের স্বাবলম্বী হওয়া, শিক্ষিত হওয়া এর কারণে ডিভোর্সের হার বেড়েছে। তবে নেপথ্য কারণ শারীরিক, মানসিক অত্যাচার। আগের যুগে নারীরা বেশিই মুখ বুজে সহ্য করতো আর এখন এটা কিছুটা কমে এসেছে। নারীদের শিক্ষা-দীক্ষা, কর্মজীবন সবকিছুর বাইরে গিয়ে পাত্রপক্ষের অযাচিত উপঢৌকন রূপ যৌতুক এর একটি কারণ। খুবই লজ্জাজনক হলেও সত্য শিক্ষার হার বেড়েছে কিন্তু সমাজের মাঝে জেঁকে বসা যৌতুক প্রথা থেকে নারীর মুক্তি মেলেনি।
নারীদের প্রতি শ্রদ্ধা-সম্মান বোধ সৃষ্টির জন্য সমূলে যৌতুক প্রথা প্রতিহত করতে হবে। এ ব্যাপারে পরিবারগুলোকে আরও সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে যে বা যারা কন্যার সঙ্গে খুশি হয়ে দেওয়া উপঢৌকন রূপ যৌতুক প্রত্যাশা করেন সেই পরিবারে কন্যার সুখে থাকার সম্ভবনা নেই বললেই চলে। পরবর্তী জীবনে সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আগেই পরিবারগুলোকে সচেতনতা অবলম্বন করতে হবে। আমরাজানি, প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধই উত্তম।