ক্রীড়াঙ্গনে নারী-পুরুষ বেতন বৈষম্য
ক্রিকেট নিয়ে আমাদের আবেগের কমতি নেই। যদিও অবকাঠামোগত নানা সমস্যার কারণে সম্প্রতি ক্রিকেটকে ঘিরে কিছুটা হতাশাও কাজ করছে। ক্রিকেট খেলা বলতেই আমরা পুরুষ দলের কথা বুঝি। এই দলটিকে ঘিরে অনেক আশা-ভরসা। কিন্তু বারবার বাজে ফলাফলে সেই আশাতেও ভাটা পড়েছে। এমন সময় নারী ক্রীড়াবিদদের সাফল্য কিছুটা শান্তির পরশ বুলিয়ে যায়। তখন আমাদের মাথায় চিন্তা ভর করে। মেয়েরা পারলে ছেলেরা পারবে না কেন?
সংবাদমাধ্যমের বরাত দিয়ে নতুন আরেকটি তথ্য আমরা পাই। এই মেয়েদের সুযোগ সুবিধার অনেক অভাব। সেই সুযোগ সুবিধার অভাব থাকা সত্ত্বেও উদ্যম আর জেতার আকাঙ্ক্ষাই তাদের সাফল্য এনে দিচ্ছে। এই সুযোগ-সুবিধার অভাবের ভেতর স্বভাবতই বেতন বৈষম্যের বিষয়টি চলে আসে। এ নিয়ে আগেও বহুবার কথা হয়েছে। কিন্তু জোরেসোরে আলোচনা শুরু হয়েছে সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের শিরোপা জয়ের পর। সংবাদমাধ্যমে বেতন বৈষম্যের খবর প্রচারের বিষয়টি যে পুরোপুরি নারী দলের স্বার্থেই বলা হয়েছে তা মনে হয়নি। পুরুষ দলের পেছনে বরাদ্দ এবং ফলাফলের ব্যস্তানুপাতিক সম্পর্ক প্রকাশ করার জন্যই এরকম খবর প্রচারিত হয়েছে। সে হোক! অন্তত কিছুটা তো মানুষের মন এদিকে ফিরেছে।
কিন্তু মনোযোগ ফেরালেই তো হয় না। ফলাফল চাই। নারী ফুটবলারদের পুরষ্কার সম্বর্ধনা দেওয়া হলেও নানা সমালোচনাও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। কিন্তু সেসব এই আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের মনোযোগ বেতন বৈষম্যে। ক্রিকেটে নারীরা বরাবরই বেতন বৈষম্যের শিকার। ভারতের নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক মিতালি রাজের বেতনও বেশি ছিল না। তবে ভারতে ক্রীড়াক্ষেত্রে অর্থ বিনিয়োগ এবং সুযোগ সুবিধা বাড়ানোর নানা পথ তৈরি হয়ে যায়। আলোচনা উঠতেই সবাই সমাধানে ব্যস্ত হয়। আমাদের দেশে আলোচনা চলতেই থাকে। যদিও অতি সম্প্রতি ভারত জাতীয় দলের বেতন বৈষম্য পুরোপুরি দূর করা হয়। তবে নারী-পুরুষ বেতন বৈষম্যের বিষয়টি প্রথম সরিয়েছে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ড।
মূলত জাতীয় দলের পরিসরে বেতন বৈষম্য দূর করার এই পদক্ষেপ থেকেই ফের আলোচনা শুরু। কিন্তু পরিবর্তন কোথায়? নারীদের জন্য স্পন্সরের অভাব এবং বিনিয়োগের সুযোগ কম এমন ছুতো নতুন নয়। কিন্তু বাস্তবে কি এমনটাই সত্য? অবশ্যই নয়। ক্রিকেট বোর্ডের এ ব্যাপারে ভূমিকা কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ। অবশ্য দেশের ক্রিকেট বোর্ড বরাবরই নানা প্রশ্নবিদ্ধ কাজ করে যাচ্ছে।
সম্প্রতি মহিলাদের জন্য ফ্র্যাঞ্জাইজ ক্রিকেট চালু হয়েছে। বাংলাদেশকে আইসিসির বার্ষিক সূচীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সবদিক বিবেচনায় নারী ক্রিকেটারদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধার পথ আছে। সেই পথগুলোকে ব্যবহার করার মঞ্চ প্রস্তুত করার দায়িত্ব ক্রিকেট বোর্ডকেই নিতে হবে। নারী ক্রিকেটারদের অভিভাবক হিসেবে ক্রিকেট বোর্ডের আপাতত কোনো পরিকল্পনা আছে কি? নারী ফুটবলের জাগরণে দেশে একটি ক্লাব যেমন ভূমিকা পালন করে আসছে তা সবারই জানা। কিন্তু ক্রীড়াক্ষেত্রের সবখানে এমন ক্লাব খুঁজে পাওয়া যাবে এমন আশা করা যায় কি?
আমাদের দেশে এখনও নারীরা ক্রীড়াক্ষেত্রকে পেশাদারি মঞ্চ হিসেবে ভাবতে পারেন না। তার ভালোলাগার জায়গা হিসেবেই ভাবতে হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক বাধা বিপত্তি পার হয়ে তাদের খেলতে আসতে হয়। আজ থেকে দশ বছর আগে অবস্থা আরও কঠিন ছিল। নারী ক্রিকেটারদের বেতন কম হওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে, নারীদের ম্যাচে দর্শক কম হয় এবং স্পন্সরশীপ বাবদ কম অর্থ পাওয়া যায়। অথচ দর্শকরা এখন নারীদের খেলার প্রতিও আগ্রহী হয়ে উঠছে। মিডিয়াতেও নারীদের খেলা ভালোভাবেই দেখানো হয়। বিজ্ঞাপন কিংবা অন্যান্য জায়গাতেও তাদের গুরুত্ব বেড়েছে। কিন্তু নারী ক্রীড়ার অবকাঠামো কি তৈরি হয়েছে? হয়নি। এখন বাবা-মা অন্তত মেয়েকে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করতে দেন। কিন্তু সব পরিবারের আর্থিক বুনিয়াদ শক্তিশালী না থাকায় অনেককে মাঝপথেই ছেড়ে দিতে হয় খেলার আশা। এমনটা দেশের ক্রীড়াক্ষেত্রের জন্য সুফল বয়ে আনতে পারে না।
সেজন্য শুধু আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসা করা যাবে না। দায়িত্বশীলদের আরও সহানুভূতিশীল হয়ে পরিকল্পনা গড়তে হবে। বিশেষত নারী ক্রিকেটের বেতন বৈষম্য দূর করার সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে হবে। যদি নানা অজুহাতে বেতনে সমতা বিধান করা নাও যায়, অন্তত একজন ক্রিকেটারের নিজের খরচ নির্বাহ করা সম্ভব হয় এমন বেতন কাঠামো প্রস্তুত করতে হবে। ক্রিকেট ব্যয়বহুল খেলা। সরঞ্জাম থেকে শুরু করে পরিচর্যার বিষয়টিও এখানে জড়িত। পারিশ্রমিক ভালো হলে আমরা যে আরও ভালো ফলাফল পাবো তা আর বলে দিতে হবে না।
অনন্যা/এআই