সুকুমার রায়: শিশু মনোরাজ্যের রাজা
সুকুমার রায় (১৮৮৭-১৯২৩) শিশু সাহিত্যিক এবং ‘ননসেন্স সাহিত্যের’ প্রবর্তক। ১৮৮৭ সালের ৩০ অক্টোবর কলকাতায় তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের আদিনিবাস ময়মনসিংহ জেলার মসুয়ায়। বিখ্যাত শিশুসাহিত্যিক, সঙ্গীতজ্ঞ ও যন্ত্রকুশলী উপেন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী তাঁর পিতা৷ অস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় তাঁর পুত্র।
সুকুমার রায় বহুবিধ গুণের অধিকারী। অল্প বয়স থেকেই পিতার সাহচর্যে মুখে মুখে ছড়া রচনা করতেন। এছাড়া ছবি আঁকা, ফটোগ্রাফি, নাটক রচনা বিবিধ গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি একাধারে শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার, রম্যরচনাকার, নাট্যকার। এছাড়া তিনি একবার রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকেও অভিনয় করেন। স্বদেশি আন্দোলনের সময় নিজে গান রচনা এবং গান গেয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেন। তাই সুকুমার রায়ের অবিস্মরণীয় অবদান আজ প্রায় শতবর্ষ পরে এসেও সমানভাবে গ্রহণীয়।
সুকুমার রায়ের পারিবারিক পরিবেশ তাঁর সাহিত্য সাধনার পথে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। শিশুদের সুখপাঠ্য ছড়া রচনার মাধ্যমে অতি সহজেই সুকুমার রায় তাদের মনে স্থান দখল করে নিতে পেরেছেন। শিশুদের ছাড়িয়ে তা বড়দের মনের আনন্দের সঞ্চার করে। ছড়া ও কবিতা পাঠের মধ্যে অন্তরে বিশেষ ভালোলাগার সৃষ্টি হয়। এক নিঃশ্বাসে পুরোটা পড়লেও তার দোলা থেকে যায় অনেকক্ষণ। তাঁর বাবুরাম সাপুড়ে ছাড়া শিশুদের মন ভোলাতে, ঘুম পাড়ানি ছড়া হিসেবেও গ্রাম বাংলায় মায়েরা ব্যবহার করে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাপনের পার্থক্য আসলেও সুকুমার রায় থেকে গেছেন পাঠকের অন্তরে।
বাবুরাম সাপুড়ে,
কোথা যাস বাপুরে
আয় বাবা দেখে যা,
দুটো সাপ রেখে যা-
যে সাপের চোখ নেই,
শিং নেই, নোখ নেই,
ছোটে না কি হাঁটে না,
কাউকে যে কাটে না,
করে না কো ফোঁসফাঁস
মারে না কো ঢুসঢাস
নেই কোন উৎপাত,
খায় শুধু দুধভাত
সেই সাপ জ্যান্ত
গোটা দুই আন তো
তেড়ে মেরে ডাণ্ডা
ক’রে দেই ঠাণ্ডা।
স্বরবৃত্ত ছন্দের ব্যবহার, শিশুদের জন্য অতি সহজ-সরল শব্দ ব্যবহার করে এক রসের সঞ্চার করেছেন ছড়াকার। সুকুমার রায় মাত্র ৩৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁর সৃষ্টিকর্ম এত গভীরতা দান করেছে যে আজও তা সমানভাবে গ্রহণীয়।
শিশুপাঠ্যের অন্যতম উপাদান তাঁর ছড়া, কবিতা। সেইসঙ্গে ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার মন ভালো করে দেয় কবিতা, ছড়া পাঠ। ভাল ছেলের নালিশ-ছড়াতে দুষ্টু-মিষ্টি শৈশবের নালিশ মায়ের কাছে। মায়ের কাছে সন্তানের আবদার-বাহানা-দুষ্টুমির শৈশবের স্মৃতি ভেসে আসে ছড়াটি পাঠে। ছড়াকার জীবনঘনিষ্ঠ চিত্র তুলে ধরেছেন বলেই পাঠকের হৃদয়ে কড়াঘাত করতে পেরেছেন। গ্রামবাংলার দুরন্তপনার চিত্র তুলে ধরেছেন এভাবে,
মাগো!
প্রসন্নটা দুষ্টু এমন! খাচ্ছিল সে পরোটা
গুড় মাখিয়ে আরাম ক’রে বসে–
আমায় দেখে একটা দিল ,নয়কো তাও বড়টা,
দুইখানা সেই আপনি খেল ক’ষে!
তাইতে আমি কান ধরে তার একটুখানি পেঁচিয়ে
কিল মেরেছি ‘হ্যাংলা ছেলে’ বলে-
অম্নি কিনা মিথ্যা করে ষাঁড়ের মত চেচিয়ে
গেল সে তার মায়ের কাছে চলে!
সুকুমার রায় নাম উচ্চারণের সঙ্গে যেন তাঁর মিষ্টি মিষ্টি অগণিত ছড়া মাথার মধ্যে দোলা সৃষ্টি করে। সবই এক অনবদ্য রূপের। গ্রামীণ জীবন, শৈশব-কৈশোরকালীন দুরন্তপনায় মেতে ওঠার চিত্র, গ্রাম-বাংলার সহজ-সরল জীবন, মানুষের মনের আকুতি সবই নির্মল শব্দে ছন্দের দোলায় ফুটিয়ে তুলেছেন। সুকুমার রায়ের অবিস্মরণীয় এই প্রতিভায় ভোলে না এমন পাঠক, শ্রোতা পাওয়া দুঃসাধ্য। প্রসঙ্গক্রমে তাঁর ‘আবোল তাবোল’ ছড়াটি তুলে ধরা যাক-
আয়রে ভোলা খেয়াল‐খোলা
স্বপনদোলা নাচিয়ে আয়,
আয়রে পাগল আবোল তাবোল
মত্ত মাদল বাজিয়ে আয়।
আয় যেখানে ক্ষ্যাপার গানে
নাইকো মানে নাইকো সুর,
আয়রে যেথায় উধাও হাওয়ায়
মন ভেসে যায় কোন সুদূর।…
আয় ক্ষ্যাপা‐মন ঘুচিয়ে বাঁধন
জাগিয়ে নাচন তাধিন্ ধিন্,
আয় বেয়াড়া সৃষ্টিছাড়া
নিয়মহারা হিসাবহীন।
আজগুবি চাল বেঠিক বেতাল
মাতবি মাতাল রঙ্গেতে-
আয়রে তবে ভুলের ভবে
অসম্ভবের ছন্দেতে।
তাঁর সৎ পাত্র, খাই খাই, আনন্দ, আড়ি, আদুরে পুতুল, আজব খেলা, অসম্ভব নয়, কাতুকুতু বুড়ো, খিচুড়ি, আয়রে আলো আয়, হনহন পনপন প্রভৃতি ছড়া ও কবিতায় তাঁর অবিস্মরণীয় প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছে। সুকুমার রায়ের ছড়া, কবিতা পাঠে নিমেষেই মনের আবহাওয়ার বদল ঘটে। বাষ্পের মতো উবে যায় সব চিন্তার। শিশু থেকে যুবা সবার মনের ভেতরেই অনির্ণেয় আনন্দ সৃষ্টি করে। সুকুমার রায় তাই বাংলা সাহিত্যের জগতে আজও আপন প্রতিভা বলে চির অমর, অম্লান। ভবিষ্যতেও একইভাবে সাহিত্যাকাশে প্রজ্জ্বলিত থাকবেন।