অফিস-টাইমে মেয়েদের বাসে উঠতে দেওয়া হয় না!
‘রোজ সাড়ে নয়টার মধ্যে অফিসে ঢুকতে হয়। ঘরের সব কাজ সেরে ঠিক সময়ে অফিসের উদ্দেশে রওনা দিই, প্রায় দিনই অনেক সময় হাতে রেখে রওনা দিই। কিন্তু এক দিনও সময় মতো বাসে উঠতে পারি না। অন্যান্য সময় বাসে উঠতে পারলেও অফিস টাইমেই মেয়েদের আটকানো হয়, বাসে উঠতে দেওয়া হয় না। বাসের হেল্পার থেকে শুরু করে পুরুষ যাত্রী- সবাই মিলে মেয়েদের পথ আটকায়। যারা ওই সময়ে রোজ চলাচল করে প্রত্যেক নারী একই কথা বলবে৷’
এভাবেই পাবলিক বাসে উঠতে প্রতিদিনের যুদ্ধের কথা জানাচ্ছিলেন কামরুন্নাহার। রোজ মিরপুর থেকে ফার্মগেটে (কর্মস্থান) আসতে হয় তাঁকে। ঢাকা শহরে বাসে ওঠার ওই সময়টাতে নারীদের একটা যুদ্ধ জয় করতে হয়। ব্যস্ত সময়গুলোতে বাসে নারী যাত্রী না তোলার ব্যাপারে সোচ্চার থাকে হেল্পাররা, সেই সাথে যুক্ত হয় কিছু পুরুষ যাত্রীও।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/04/1-35-1024x576.jpg)
কামরুন্নাহার তাঁর অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, “বাসের জন্য দাঁড়ানোর সাথে সাথে কয়েকজন পুরুষ এমনভাবে সামনে বা চার পাশে গিয়ে দাঁড়াবে, মনে হবে আমি একজন নারী, আমার বাসের জন্য দাঁড়ানোর অধিকার নাই। বাস শুধু পুরুষদের জন্য। আর বাস এসে থামার আগে থেকেই হেল্পার বলতে থাকে, মহিলা উঠবেন না'”!
রাজধানীর কয়েকটি ব্যস্ত এলাকায় বাসের জন্য দাঁড়ালে এমন দৃশ্য দেখি আমরাও। যদিও রাজধানীবাসীর কাছে এ-সব দৃশ্য অপরিচিত নয়। তবু কয়েকটি দৃশ্যের বর্ণনা শোনা যাক:
দৃশ্য-১
কারওয়ান বাজার এলাকায় বাসের জন্য অপেক্ষারতদের মধ্যে মাত্র চার জন নারী, বাকি ৮-১০ জন পুরুষ। একটি বাস এসে থামল আর হেল্পার চিৎকার করে ঘোষণা করছে, ‘কোনো মহিলা তোলা হবে না।’ একজন নারী হেল্পারের দিকে প্রশ্ন তুললেন, ‘তবে আমরা যাব কিভাবে?’ হেল্পার উত্তর দিল, ‘সিএনজিতে যান।’ তবে সেই নারী এমন উত্তরে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন। কারণ, বেশির ভাগ সময়ই এমন প্রশ্নের উত্তরে উড়ে আসে নানা অপমানজনক শব্দ। সে হিসেবে এই হেল্পার কেবল একটি উপদেশ দিয়েই চলে গেল।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/04/2-36-1024x576.jpg)
দৃশ্য-২
ঘটনাটা রাজধানীর ফার্মগেট এলাকার। সময় বিকেল ৫টা। অফিস শেষে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছোনোর জন্য বাসের অপেক্ষায় বহু মানুষ। এবারও যথারীতি বাসের হেল্পার ঘোষণা করতে করতে আসল, ‘মহিলা নেওয়া হবে না।’ যদিও বাইরে থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, সংরক্ষিত নারী আসনে কেবল ৩ জন নারী বসে আছেন, বাকি সবাই পুরুষ যাত্রী। কিন্তু পুরুষ যাত্রীর আধিক্য থাকার কারণে নারীদের চুপ করে দাঁড়িয়ে পরের বাসের জন্য অপেক্ষা করতে হয়।
দৃশ্য -৩
এবার একটু বাসের ভেতরের দৃশ্যের কথা বলা যাক। একজন নারী হেল্পারের বাধা অমান্য করে উঠে গেলেন বাসে। বাসের মধ্যে সুযোগসন্ধানী কয়েকজন পুরুষ যাত্রী ওই নারীকে হয়রানি শুরু করলে প্রতিবাদ করেন সেই নারী। বাসের প্রায় ৯০ শতাংশ পুরুষ যাত্রী একজোট হয়ে সেই নারীর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দেয়, ‘হেল্পারের নিষেধ সত্ত্বেও কেন বাসে উঠলেন।’ হেল্পার বিরক্তের সুরে বলল, ‘এ-জন্যই মহিলাদের বাসে তুলি না।’
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/04/5-32-1024x576.jpg)
শুধু যে বাসের যাত্রীদের কাছ থেকেই নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন, তা নয়। পরিবহনশ্রমিক, চালক, হেল্পার থেকেও হয়রানির শিকার হন নারীরা।
দিন-শেষে সব পুরুষ সাধুই রয়ে যায়। নারীর দোষ, কেন সে বাসে উঠল!
আজকাল নারীদের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে ‘গণপরিবহন’। বেশির ভাগ নারীই মনে করতে পারেননি, শেষ কবে তিনি হয়রানির শিকার হননি। পরিবহনে ওঠা থেকে নামা পর্যন্ত প্রতি মুহূর্তে আতঙ্কিত থাকতে হয় নারীদের।
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/04/4-34-1024x576.jpg)
গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে, বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি জানিয়েছে, ‘২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১১ মাসে গণপরিবহনে ৬৮টি নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ২৩টি ধর্ষণ, ১১টি দলবদ্ধ ধর্ষণ এবং ৩৪টি যৌন হয়রানি।’
২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্র্যাকের প্রকাশিত ‘নারীর জন্য যৌন-হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন।’
![](https://a.kha.icu/wp-content/uploads/2022/04/3-37-1024x576.jpg)
মোদ্দাকথা দাঁড়াল, গণপরিবহন ব্যবহারে নারীর না আছে সাচ্ছন্দ্য, না আছে নিরাপত্তা। তবে শুধু কি নিয়মের বেড়াজালেই এ-সব সমস্যা সমাধান করা সম্ভব? যদি তাই হতো তবে সংরক্ষিত ৯ আসনে পুরুষ সদস্যরা বসে মুচকি হেসে নারীদের উদ্দেশে বলত না, ‘সমান অধিকার তো, দাঁড়িয়ে যান।’
অনন্যা/এসএএস