বাসে সিসি ক্যামেরা, কী ভাবছেন সাধারণ যাত্রীরা
‘ক্লাস শেষে পাবলিক বাসে ৩ জন আশুলিয়া থেকে ফিরছি। গাড়িতে যাত্রী উঠছেন-নামছেন। এরইমধ্যে বাসে ২ জন উঠলেন সাহায্যের জন্য। একজন ২২/২৩ বছরের ছেলে অন্যজন বোরকাপরা। শুরুতেই তারা বাসের সবাইকে জানালেন সঙ্গে থাকা মেয়েটির পেটে বাচ্চা নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা এখন টিউমারে রূপ নিয়েছে। সবাই যেন তাকে সাহায্য করেন। ব্যস, এরপর শুরু হলো সাহায্য নেওয়া। শুরুতে বুঝতে পারিনি তাদের উদ্দেশ্যটা কী!
কিছুক্ষণ পর এলেন আমার কাছে সাহায্য নিতে। এসে কিছু না বলেই হাত ধরছেন, চেষ্টা করছেন শরীরে হাত দেওয়ার। বাসে প্রত্যেকটা মেয়ের সঙ্গেই করছেন একই কাহিনি। হাত আর চাহনি দেখে বুঝতে বাকি রইলো না বোরকার ভেতরের মানুষটাও ছেলে। সাহায্য নিতে এসেছেন অথচ কথাবার্তা তিনি বলছেন না। বলছে অন্য ছেলেটি। তাকালাম পায়ের দিকে। দেখলাম চামড়ার সেন্ডেল পায়ে। তারাও হয়তো বুঝেছেন ততক্ষণে ধরা পড়ার আশঙ্কা না রয়েছে। তাই আর দেরি না করে চট করে নেমে পড়লেন বাস থেকে।’
বাসে সিসি ক্যামেরা বসানো নিয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে এভাবেই তার সঙ্গে ঘটা একটি ঘটনার বর্ণনা দেন। পাবলিক বাসে চড়ার অনুভূতি তেমন কখনোই তার জন্য সুখকর ছিল না। বাসে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটা নতুন কিছু না। তাই পাবলিক বাস মানেই নারীদের কাছে আতঙ্ক। তাই বাসে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের বিষয়টি তিনি দেখছেন ইতিবাচক ভাবে। তিনি বলেন, ‘আগে যেমনটা হতো, যখনই কোনো হ্যারাসমেন্টের শিকার হতাম ভয়ে প্রতিবাদ করতাম না। কারণ প্রতিবাদ করলেও একদল মানুষ উল্টো আমাদের গায়েই দোষ দিতো, নিজেকে প্রমাণ করারও কোনো উপায় ছিল না। এবার এই বিষয়টি থেকে অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবো। আবার অনেকে আগে যেই অন্যায়টা সহজেই করতে পারতো এখন তা করার আগে বেশ কয়েকবার ভাববে।’
এ বিষয়ে বাসের আরেক সাধারণ যাত্রী হুমায়ুন কবির মাসুদও কথা বলেন। থাকেন রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকায়। কাজের সূত্রে রোজ তাকে যেতে হয় গুলশান৷ পাবলিক বাসের অনুভূতি তার কাছেও খুব একটা ভালো নয়। তিনি বাসে সিসি ক্যামেরা স্থাপন নিয়ে বলেন, ‘বাসে অনেক ধরনের আপত্তিকর ঘটনা প্রত্যেকবারই চোখে পরে। নারীদের হয়রানির বিষয়টি তো অবশ্যই বেশি দেখা যায়। আমার চোখের সামনেই এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। তবে কাউকে দোষ দেওয়ার আগে তো আমাদের জানতে হবে সে আসলেই অপরাধী কিনা। এতদিন এই বিষয়টি যাচাই করার সুযোগ ছিল না। আমার মনে হয় এবার সে সুযোগটি থাকবে, যার কারণে অন্যায় অনেক কমে আসবে। বিনা দোষে কাউকে শাস্তি পেতে হবে না, আবার কেউ ভিকটিম ব্লেমিংও করতে পারবে না।’
এ বিষয়ে আরও কথা বলেন একজন কর্মজীবী নারী তৃনা জুলিয়েট মার্ডী। চাকরির সুবাদে তারও রোজ পাবলিক বাস ব্যবহার করতে হয়। তিনি বলেন, ‘বাসে একজন নারী উঠবে আর হয়রানির শিকার হবে না, তা তো ভাবাই যায় না। তাও যদি আবার অফিস টাইমের ওই ভিড়ের মধ্যে হয়। হেল্পার, যাত্রী সবাই যেকোনো উপায় হয়রানি করার চেষ্টা করে। আবার এক মুহূর্তে অস্বীকার করে ফেলে। এই অস্বীকার করার প্রবণতা কমবে যদি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। তারপর বাসে চুরি হওয়াটাও অনেক স্বাভাবিক ঘটনা আজকাল। সিসিটিভি ফুটেজ থাকলে সহজেই শনাক্ত করা যাবে।
উল্লেখ্য, নারীর নিরাপত্তা ও নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করতে ঢাকার গণপরিবহনে ১০০ সিসি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে । সরকারি অর্থায়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়নে কাজ করছে ‘দীপ্ত ফাউন্ডেশন’ নামে একটি এনজিও।
ঢাকায় ই-টিকেটিং-এর আওতায় থাকা চারটি পরিবহন কোম্পানির ২৫টি করে মোট ১০০ বাসে এই ক্যামেরা লাগানোর কাজ শুরু হয়েছে গত ১৬ অক্টোবর থেকে। যে চারটি কোম্পানির বাসে ক্যামেরা স্থাপন করার কাজ চলছে সেগুলো হলো, বসুমতি, পরীস্থান এবং রাজধানী পরিবহন। সাধারণ যাত্রীরা বিষয়টি যেমন ইতিবাচকভাবে দেখছে আবার শঙ্কায় আছে, আদৌও এই পরিকল্পনা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হবে কি না।