ইলা মিত্রের মৃত্যুবার্ষিকী আজ
তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্রের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুব কমই পাওয়া যাবে। বাংলার কৃষকের অধিকার আদায়ে ইলা মিত্রের নাম ইতিহাসের পাতায় উজ্জ্বল অক্ষরে লেখা রয়েছে। বঞ্চিত – শোষিত মানুষের পাশে দাঁড়াতে এই নারী যে ত্যাগ করেছেন তা তো ভুলে যাওয়ার মতো নয়। সংগ্রামী এই নেত্রীর মৃত্যুবার্ষিকী আজ।
ইলা মিত্র ১৯২৫ সালের ১৮ অক্টোবর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের সময় ইলা মিত্র ছিলেন ইলা সেন। তার বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের অধীন বাংলার একাউন্টেন্ট জেনারেল। তাদের আদি নিবাস ছিল তৎকালীন যশোরের ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে তারা সবাই কলকাতায় থাকতেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন রাজ্য জুনিয়র এ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। সাঁতার, বাস্কেটবল ও ব্যাডমিন্টন খেলায়ও তিনি ছিলেন পারদর্শী। তিনিই প্রথম বাঙালি মেয়ে যিনি ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল হয়ে যাওয়ায় তার অংশগ্রহণ করা হয়নি।
ইলা সেন যখন বেথুন কলেজে বাংলা সাহিত্যে বি.এ সম্মানের ছাত্রী তখন থেকেই রাজনীতির সাথে পরিচয় ঘটে। নারী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার রাজনীতিতে প্রবেশ। সময়টা ছিল ১৯৪৩ সাল, ইলা সেন কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হলেন। হিন্দু কোড বিলের বিরুদ্ধে ঐ বছরই মহিলা সমিতি আন্দোলন শুরু করে। সমিতির একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি এই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি সনাতন-পন্থীদের যুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে অনেক প্রচার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি নামক সংগঠনের মাধ্যমে নারী আন্দোলনের এই কাজ করতে করতে তিনি মাত্র ১৮ বছর বয়সে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ করেন।
১৯৪৫ সালে ইলা সেনের বিয়ে হয় দেশকর্মী কমিউনিস্ট, রামচন্দ্রপুর হাটের জমিদার এর ছেলে রমেন্দ্র মিত্রের সাথে। বিয়ের পর তিনি কলকাতা ছেড়ে চলে এলেন শ্বশুরবাড়ি রামচন্দ্রপুর হাটে। হিন্দু রক্ষণশীল জমিদার পরিবারের নিয়মানুসারে অন্দরমহলেই থাকতেন ইলা মিত্র। তবে একসময় বাড়ির কাছেই কৃষ্ণগোবিন্দপুর হাটে মেয়েদের জন্য একটি স্কুল খোলা হলো। গ্রামের সবার দাবিতে মাত্র তিনজন ছাত্রী নিয়ে স্কুলটি শুরু হয়। পরে ইলা মিত্রের আন্তরিক পরিচালনায় তিনমাসের মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫০-এ।
সংগ্রামী নেত্রী এভাবেই অন্দর মহল থেকে বের হয়ে এসে আবার নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন বৃহত্তর সমাজ সেবার কাজে। হয়ে ওঠেন এলাকার রানীমা। এ সময়ে তিনি স্বামী রমেন্দ্র মিত্রের কাছে জমিদার ও জোতদারের হাতে বাংলার চাষিদের নিদারুণ বঞ্চনা শোষণের কাহিনী শোনেন। আরও শোনেন এই শোষণের বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনের প্রচেষ্টার কথা। স্বামীর আদর্শ ও পথ চলার সাথে নিজেকে যুক্ত করেন তিনি। ১৯৪৬ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত রাজশাহীর নবাবগঞ্জ অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দান করেন ইলা মিত্র।
কার্ল মার্ক্স দ্বারা প্রভাবিত ইলা মিত্র বেশ কয়েকটি রুশ গ্রন্থ অনুবাদ করেন- জেলখানার চিঠি, হিরোশিমার মেয়ে, মনে প্রাণে-২ খণ্ড, লেনিনের জীবনী, রাশিয়ার ছোট গল্প ইত্যাদি। হিরোশিমার মেয়ে বইটির জন্য তিনি ‘সোভিয়েত ল্যান্ড নেহেরু’ পুরস্কার লাভ করেন এবং এ্যাথলেটিক অবদানের জন্য তিনি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ভারত সরকার তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে স্বতন্ত্র সৈনিক সম্মানে “তাম্রপত্র পদক” এ ভূষিত করে সম্মানিত করে।
২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর এই মহীয়সী নারী মৃত্যুবরণ করেন। আজ তার মৃত্যুবার্ষিকী। কিন্তু যিনি সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় স্বেচ্ছায় জীবনের সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়েছেন, ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন তার নাম আজীবন উজ্জ্বল থাকবে ইতিহাসের পাতায়।