মায়ের সম্মান নিয়ে যা বললেন জাভেদ আখতার
সম্প্রতি ভারতের একটি টিভি টকশোতে ভারতীয় কবি, গীতিকার ও চিত্রনাট্যকার জাভেদ আখতারের সামনে যখন সঞ্চালনক বললেন, ‘মা একজন মানুষের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ’, তখন তিনি উল্টো কথা বললেন। তিনি বললেন, যে সমাজে মায়েদের পূজা হয়, সেখানে নারীদের অবস্থা খারাপ হবেই। সেই কথাটি তিনি কেন বলেছেন?
জাভেদ আখতার প্রশ্নের উত্তর ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, যখন একটা বাচ্চা জন্ম নেয় বহুদিন পর্যন্ত বাচ্চাটি বোঝেই না যে, সে আর তার মা দুটি আলাদা শরীর।
জাভেদ আখতার সবার উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা দেখেছেন নিশ্চয়ই যখন বাচ্চাকে আপনি দোলা দেন, তখন বাচ্চা ঘুমিয়ে যায়। যখন বাচ্চার পিঠে হাত বোলান, সে ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু বড় মানুষকে আপনি নাড়া দিলে সে জেগে যাবে। বড় মানুষকে আঘাত করলে তার ঘুম ভেঙে যাবে। বাচ্চা কিভাবে ঘুমিয়ে যায়?’
এর কারণ হচ্ছে বাচ্চা যখন মায়ের পেটে ছিল, তখন সে মায়ের হৃদস্পন্দন শুনেছে ‘ধক ধক ধক’। তাই যখন আপনি তার পিঠ চাপড়ান, তখন সে ভাবে হৃদস্পন্দন শুনছে। সে ভাবে আমি নিরাপদ, আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি।
যখন আপনি বাচ্চাকে দোলা দেন সে ভাবে এখনো গর্ভেই আছে, দোল খাচ্ছে তার মধ্যে নিরাপত্তা বোধ জন্মায়। অনেক পরে গিয়ে বাচ্চা বুঝতে পারে, সে আর তার মা দুটি আলাদা শরীর, আলাদা মানুষ। সেই কষ্ট দূর করতে সে মায়ের মতো কিছু একটা খোঁজে টেডি বিয়ার কিংবা কম্বল। যেই জিনিসটা সবসময় নরম-গরম মোলায়েম হবে মায়ের মতো। বাচ্চা ভাবে, মা যেহেতু নেই, তার মতো কিছু একটা কাছে রাখি।
এই বাচ্চাটিই যখন বড় হয়, তখন সে দেখে তার মায়ের সঙ্গে অন্যায় হচ্ছে তার বাবা খারাপ ব্যবহার করছে তার দাদি, ফুফুরা খারাপ ব্যবহার করছে। ওই বাড়িতে তার মা খারাপ ব্যবহার পাচ্ছে। এই সময় বাচ্চাটি ভাবে আমি বড় হয়ে মায়ের জন্য কিছু করবো এবং মায়ের জন্য তার মনে প্রচণ্ড ভালোবাসা তৈরি হয়। সে তার মাকে পূজনীয় ভাবতে থাকে।
এরপর সন্তান যখন বড় হয়, তখন সে তার মায়ের ছেলে কিন্তু এখন সে নিজেও পুরুষ হয়েছে। এখন তাকে অন্য নারীদের ওপর জুলুম করতে হবে। ছেলেটি মায়ের প্রতি পজিটিভ ভাবনাটাকে চাবুক বানিয়ে ফেলে। অন্য নারীদের ওপর চাবুকটা চালায়।
ছেলেটি তার বউ কে বলবে, ‘তুমি আমার মায়ের মতো ডাল রান্না পারো না, তুমি আমার মায়ের মতো ঘর সামলাতে পারো না।’ সেই ছেলেটি মাকে মুলা হিসেবে বউয়ের সামনে ঝুলিয়ে দেয়, ওই বউ সারাজীবনেও সেই মুলা ধরতে পারে না। আমাদের সমাজের সব শাশুড়ি তার বউয়ের থেকে ভালো ডাল রান্না করে। মানে ৫ হাজার বছর ধরে খাবারের স্ট্যান্ডার্ড কমছে!
মা পূজনীয়, মায়ের পায়ের নিচে স্বর্গ। মা অনেক সম্মানীয় ও ভালোবাসা পাবেন। আরে ভাই, মা অনেক সম্মানীয় এটা যে বার বার বলছ, তাহলে কে আছে যে সম্মানীয় নয়? অন্য নারীরা?
বাবাদের ব্যাপারে তো কেউ কথা বলে না! বাবার অনেক সম্মান হওয়া উচিত। আরে, বাপকে সম্মান না করলে ঘর থেকে বের করে দেবে! মায়ের পায়ের নিচে স্বৰ্গ আবার বাবার পায়ের নিচে সম্পত্তি!
এই যে মাকে সম্মান করার চেতনা, এটা একটা লাইসেন্স, মাকে সম্মান করো। তাই বলে বাকি নারীরা কি হিসাবের বাইরে? মায়ের সম্মান মানে সেটা কোন ‘মা’? আমার মায়ের? তাহলে আমার বাচ্চার মা? তাকে কি সম্মান করতে হবে না? আর আমার মা কখন সম্মান পাবেন?
আমার জন্ম হয়েছিল ১৭ই জানুয়ারি ১৬ই জানুয়ারি কি সে সম্মানীয় ছিল না? যদি ওইদিন সে সম্মানের যোগ্য না হয়ে থাকে তাহলে মা কীভাবে সম্মানীয়? সম্মানীয় তো আমি! উনি তো আমার সম্মানটাই পাচ্ছেন! এগুলো হলো অবান্তর ভাবনা।
সব নারী সম্মানীয়, শুধু মা কেন? এই সমাজে মাকে দেবী বানানো হয়। আরে মা মানুষ, দেবী না। তুমি তাকে মানুষের সম্মান দিচ্ছ না। দেবী বানিয়ে রেখে দিয়েছ, তাহলে বাবা দেবতা; এটা তো কেউ বলে না। শুনেছেন কখনো? আমি তো শুনিনি।