Skip to content

১৪ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | সোমবার | ২৯শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নীলিমা ইব্রাহীম: একজন অনন্যা

বাংলাদেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎদের মধ্যে একজন ড. নীলিমা ইব্রাহিম। সমাজ ও সংস্কৃতির নানা প্রতিকূলতার মধ্যে আজন্ম নারীর আত্নোন্নয়নে কাজ করে গেছেন এই অনন্যা। সারা জীবন সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্যেই লড়াই করে গেছেন যা সময়ের হিসেবে বিস্ময়কর। এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে পরিচিতি লাভ করেছেন শিক্ষাবিদ, সাহিত্যিক এবং সমাজকর্মী হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীদের পুনর্বাসনে তার অবদান ভুলে যাওয়ার কোনো অবকাশ নেই। সবকিছু মনে না থাকলেও তার ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ আজীবন মুক্তিযুদ্ধে নারী সংগ্রামের এক প্রামাণ্য দলিল হিসেবে টিকে থাকবে।

১৯২১ সালের ১১ অক্টোবর বাগেরহাটের মূলঘর গ্রামের কে জমিদার পরিবারে নীলিমা ইব্রাহীম জন্মগ্রহণ করেন। তার আসল নাম নীলিমা রায় চৌধুরী। নীলিমার বাবা প্রফুল্ল রায় চৌধুরী পেশায় আইনজীবী ছিলেন। আদালত প্রাঙ্গণের মানুষটির থিয়েটারের প্রতি অগাধ আগ্রহ ছিল। এজন্য তিনি দীর্ঘদিন খুলনা নাট্য মন্দিরের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। থিয়েটারের আগ্রহ দ্রুতই সন্তানদের মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন।

খুব ছোটবেলা থেকেই তাই মেধা বিকাশের উৎসাহ পেয়েছিলেন নীলিমা ইব্রাহীম। ওই সময়ে খুলনা করোনেশন গার্লস স্কুল থেকে চারটি বিষয়ে লেটার নিয়ে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। তারপর তিনি কলকাতার ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউট থেকে আইএ এবং কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বিএবিটি সম্পন্ন করেন। কিন্তু সেখানেই পড়ালেখার পাট শেষ করেন নি। ভর্তি হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সাহিত্য বিভাগে। সেখানেও মেধার সাক্ষর রেখে প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। পড়ালেখা শেষে শিক্ষকতা জীবনের শুরু। প্রথমে লরেটো হাউজ এবং ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউটে শিক্ষকতা করেন। এরই মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগেও শিক্ষকতার সুযোগ পান। নীলিমা ইব্রাহীমের মেধা এবং প্রতিভার স্বীকৃতিস্বরুপ ১৯৪৫ সালে প্রথম নারী হিসেবে বিহারিলাল মিত্র বৃত্তি দেওয়া হয়। এরপর ১৯৫৯ সালে প্রথম নারী হিসেবে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি পান।

কিন্তু কিভাবে নীলিমা রায় চৌধুরী নীলিমা ইব্রাহীম হয়ে উঠলেন? ১৯৪৫ সালে তৎকালীন ইন্ডিয়ান আর্মি মেডিকেল কর্পসের ক্যাপ্টেন ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহীমের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই তার নাম বদলে নীলিমা ইব্রাহীম করা হয়। ঢাকার গেন্ডারিয়ায় শ্বশুড়বাড়িতে কিছুদিন অবস্থান করেন। অবশ্য স্বামীর চাকরিতে বদলির কারণে প্রায়ই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকতে হয়েছে। ডক্টরেট সম্পন্ন করার সময়ে তার পাঁচটি সন্তান। এক হাতে সংসার এবং গৌরবোজ্জ্বল শিক্ষাজীবন পার করেছেন।

গবেষণায় নীলিমা ইব্রাহীমের আগ্রহ ছিল থিয়েটার। বাবার অনুপ্রেরণা তো ছিলই, গবেষণার সুযোগ পাওয়ার পর ‘সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমিকায় ঊনবিংশ শতাব্দীর বাংলা নাটক’ এই বিষয়ে গবেষণা করেন। তিনি নিজেও বেশ কয়েকটি নাটক লিখেছেন। প্রতিটি নাটকেই নারীর প্রতি সামাজিক বৈষম্যের বিষয়টি বহুবার উঠে এসেছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি উপন্যাসও লিখেছেন। ষাটের দশকটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য খুবই জরুরি সময়। এ সময় থেকেই বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় পাকিস্তানি শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে রুখে প্রতিবাদ করতে শুরু করে। সেই সময়টিতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীলিমা ইব্রাহিমের আগমন। ১৯৫৬ সালে প্রভাষক পদে বাংলা বিভাগে যোগ দেন। সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠা নবীন এই শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় অঙ্গনে নানাবিধ সাহিত্য-সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন।

নীলিমা ইব্রাহীমকে ঠিক নারীবাদি লেখিকা বলার সুযোগ নেই। মূলত নারীর ব্যক্তিত্বের বিকাশ, স্বাধীন সত্ত্বার উন্মোচন, এবং সমাজের বৈষম্যের পর্দা উপড়ে তার যথাযোগ্য স্থান নির্ণয়ের প্রয়াস করেছেন। সামাজিক বৈষম্যের অচলায়তন ভেঙে নারীর সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন লাভের জন্য লিখেছেন। তার বিশ্বাস ছিল নারী ও পুরুষের সম্মিলিত প্রয়াসেই মানবমুক্তি মিলবে। ঠিক একই সুর নজরুলেও পেয়েছি। এছাড়াও রাজনীতি-সচেতন হিসেবেও তার খ্যাতি অনেক। পাকিস্তান সামরিক সরকারের বাঙালী দলনীতির কট্টর সমালোচনা করতে পিছপা হন নি কখনো। শুধু সমালোচনাই নয়। বহু অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজে নেমে পড়েছিলেন। অনেক মানুষকে অন্যায়ের হাত থেকে উদ্ধার করেছেন। ছাত্রদের মধ্যেও তার জনপ্রিয়তা বেড়েছিল। বিভিন্ন স্মৃতিচারণায় তা আমরা বহুবার পেয়েছি। পরম মমতায় উনসত্তরের ছাত্র আন্দোলন, ছয় দফা-এগার দফার অংশগ্রহনকারীদের আশ্রয় দিয়েছেন। তাদের উজ্জীবিত করেছেন। পাকিস্তান সরকারের নজরদারিকে তোয়াক্কা করতেন না।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঝুঁকি নিয়ে তিনি দেশে অবস্থান করেছিলেন। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু সরকার নারী পুনর্বাসন বোর্ড গঠনের পর নীলিমা ইব্রাহীমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তার ফসল তো আমরা পেয়েছি। সেকথাও আছে ‘আমি বীরাঙ্গনা বলছি’ বইটিতে। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ১৯৭৪ এ তিনি বাংলা একাডেমির দায়িত্ব নেন। সেখানে মকবুল নাম এক ভণ্ড খাদেমের অপতৎপরতায় বাংলা একাডেমির জমি বাজেয়াপ্তের শঙ্কা ছিল। কঠোর হস্তে তিনি এই মকবুলের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করেছিলেন। মহিলা সমিতির সভাপতি হিসেবেও কাজ করেছেন দক্ষতার সঙ্গে।

দুঃখের বিষয় হলো তাকে একবার কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলের শেষ দিকে ‘মাগো আমি কো্য্যাবো’ লেখার জন্য তার নামে রাষ্ট্রবিরোধী মামলা ঠুকে দেওয়া হয়। নানা টালবাহানায় অসুস্থ নীলিমা ইব্রাহীমের জামিন বিলম্বিত করা হয়। তবুও সৎ থেকেছেন লেখায়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আজকের কাগজে লিখেছেন। লেখায় তার জুড়ি মেলা ভার। নারী আন্দোলনের পথিকৃৎ এবং কলম-সৈনিক হিসেবে তার খ্যাতিয়াকাশচুম্বী।

২০২০ সালের ১৮ জুন, নীলিমা ইব্রাহীম না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তার কাজ ও আদর্শকে এখন আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণের সুযোগ রয়ে গেছে।

অনন্যা/এআই

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ