নারীবাদের বিরুদ্ধে পুরুষতন্ত্রের প্রচারণা
নারীবাদ শব্দটি শুনলেই যেন পুরুষতন্ত্রের গায়ে ফোস্কা পড়ে। শব্দটির ইতিবাচক রূপকে অস্বীকার করাই তাদের কাজ। কারণ নারীবাদীরা যে তাদের বাড়া ভাতেই ছাই দেয়। ফলে তাদের গা-জ্বলাটা অস্বাভাবিক নয়। তবে নারীবাদ সম্পর্কে সঠিক ব্যাখ্যাটাও জানেন না, এসব কূপমণ্ডূকের দল। কারণ তাদের কাছে একটাই ব্যাখ্যা একটাই পথ নারী মানেই অবরুদ্ধ ঘরের বাসিন্দা। ঘরের বাইরে তারা ঘূর্ণাক্ষরেও পা দেবে না, এটাই তাদের প্রত্যাশা। আর সেই প্রত্যাশায় জল ঢেলে যখন বিশ্বে নারীরা মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে তখনই পুরুষতন্ত্রের গায়ে গরম খুন্তির ছ্যাঁকা লাগছে। নারীবাদ শব্দটির অপব্যাখ্যা ছড়িয়ে নারীবাদীদের একটা গোত্রের অন্তর্ভুক্ত করে ফেলার অপচেষ্টা করছে। কিন্তু নারীবাদ কী? নারীবাদীদের উদ্দেশ্যই বা কী? যুগ যুগ ধরে এই শ্রেণির লড়াই কেন? সেগুলোর উত্তর কি কখনো খুঁজতে চেষ্টা করেছেন নারীবিদ্বেষী মানুষ?
বিশ্বে নারীদের অবরুদ্ধ করতে চলছে নানারকম ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। প্রতিনিয়ত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পুষ্টদের মনোরঞ্জনের খোরাক নারীবাদীরা। সাধারণের ধারণা পুরুষ বিদ্বেষই নারীবাদীর সংজ্ঞা। কিন্তু নারীবাদের কোথাও এরূপ কোনোরকম কথা বলা নেই। বরং নারীবাদীরা নারীর অর্থনৈতিক, চলাফেরা, কথা বলার স্বাধীনতা, পৈতৃক সম্পত্তির সঠিক বণ্টনের কথা বলে।
নারীবাদ হলো নারী ও পুরুষের মধ্যকার সমতার একটি মতবাদ। যার দ্বারা নারীর ওপর পুরুষের আধিপত্য বিস্তার রোধে নারীদের সংগঠিত করা হয়। সামাজিক জীব হিসেবে সমঅধিকার ও দায়িত্বের ভিত্তিতে নারী-পুরুষের জন্য সমাজকে নিরাপদ আবাসস্থলে রূপান্তরিত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। মূলত নারীবাদের মতাদর্শ হলো নারীরা রাজনৈতিক, সামাজিক, লৈঙ্গিক, বৌদ্ধিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পুরুষের সমান অধিকার লাভ করবে। নারীবাদের কর্মকাণ্ড বৃহৎ পরিসরে নারীদের অবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত। নারী যেখানে বৈষম্যের শিকার, পুরুষের অধস্তন, সেখানে নারীবাদ এ অবস্থার পরিবর্তন সাধনে পরিচালিত। নারীবাদীরা সমতায় বিশ্বাসী। নারীদের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার। কিন্তু নারীবাদীর সংজ্ঞা উল্টে পুরুষতন্ত্র করেছেন তাদের মন মতো। তারা নারবাদী বলতে বোঝেন যিনি মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলবেন, বেফাস মন্তব্য করবেন, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করবেন, নারীরা ভুল করলেও তার পক্ষে কথা বলবেন এরূপ আরও কিন্তু মনগড়া সংজ্ঞা। যার ফলে নারীবাদের প্রকৃত সত্তা বা থেকে তার ডিগবাজি খেয়ে পড়েন বিপাকে!
সমাজের নারীর গুম, খুন, ধর্ষণ, যৌনহয়রানি মতো জঘন্য অপরাধগুলো ঘটলে খুব একটা মুখের প্রকৃত গালির মতোই ব্যবহার করেন এবার নারীবাদীরা উঠে-পড়ে লাগবে! এগুলো বলেন সমাজের পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞাবহরাই। তাদের কাছে একটি প্রশ্ন-যদি নাররবাদীরা সোচ্চার না হন এহেন অপরাধে, তবে কি আপনারাও এটাকে স্বীকার করে নেবেন বা হজম করে থাকবেন? এ ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা কি অপরাধ নয়? না কি পুরুষতন্ত্রের বিপক্ষে যায় বলেই নারীবাদীরা আপনাদের চক্ষুশূল?
অন্যায়কে অন্যায় বললেও তাদের গায়ে লাগে। খুব একটা স্বস্তি পান না। মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। নারীকেও মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা জরুরি। আধুনিক যুগে এসেও যে আজ একথা বলতে হচ্ছে তা সত্যিই লজ্জাজনক! গড়ে উঠুক বিবেকসম্পন্ন মানুষ। ঘুচে যাক অন্ধকার।
নারীবাদী আন্দোলন তিনটি ধারায় পরিচালিত হয়েছে। নারীবাদের প্রথম ধারাটি যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রে সক্রিয় ছিল। এ পর্যায়ে বৈবাহিক চুক্তিতে সমঅধিকার এবং সম্পত্তি লাভ ও ভোগ করার অধিকার অর্জনের দাবি উত্থাপনের মাধ্যমে প্রথম ধারা যাত্রা শুরু করে। তবে উনিশ শতকের শেষভাগে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ প্রধান দাবিতে পরিণত হয় এবং নারীবাদী আন্দোলন নারীর ভোটাধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। পরবর্তীকালে নারীরা নিজেদের অধিকার পেতে সক্ষম হয়। দ্বিতীয় ধারায় এসে নারীবাদী আন্দোলন ব্যাপকতা লাভ করে। জীবনের সব ক্ষেত্রে সব বৈষম্য দূর করে সমতা প্রতিষ্ঠা নারীবাদের লক্ষ্য হিসেবে গৃহীত হয়।
বিশ্বের নারীরা আজও যার জন্য লড়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। তৃতীয় ধারার নারীবাদ বিশ্বাস করে যে, ঔপনিবেশিক পাশ্চাত্য দেশগুলোর হাতে বর্ণগত, শ্রেণিগত ও নৃগোষ্ঠীগত শোষণ ঔপনিবেশিক উত্তর সমাজে নারীকে প্রান্তিক করে রেখেছিল। তৃতীয় ধারার নারীবাদ মূলত স্থান ও সংস্কৃতি ভেদে নারীদের পরস্পর থেকে ভিন্ন বলে মনে করে। নারীদের পূর্ণ অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা। ফলে নারীবাদ মূলত নারী ও পুরুষের সমতার কথা বলে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে নারীবাদের অর্থ দাঁড়িয়ে গেছে পুরোই ভিন্ন। তবে এক্ষেত্রে তারা তাদের সুবিধা, অজ্ঞতা, অশিক্ষার কারণে নারীবাদের বিরূপ সংজ্ঞা দাঁড় করিয়েছন। যেন নারীদের সমতার কথা বলা বন্ধ হয়। নারীরা নিজেদের অধিকার ভুলে তাদের মানসিকতাকে সমর্থন করে। নারীবাদী সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করে কেউ যদি এর আওতায় স্বেচ্ছাচারে লিপ্ত হন তবে নিশ্চয় তা অপরাধ। অন্যায়-অবিচার সবসময়ই অপরাধ সে নারীবাদের আওতায় হোক বা মোল্লাতন্ত্রের আওতায় বা পুরুষের নিজ স্বার্থে। তার জন্য তো নারীবাদী যেটা সমতার কথা বলে, অন্যায়কে রুখে দেওয়ার তাগিদে সৃষ্ট তাকে কলুষিত করা যায় না।
পুরুষতন্ত্রের আজ্ঞাবহদের ইচ্ছে পৃথিবীর যত কিছুই ঘটে যাক, নারীরা থাকবেন অবরুদ্ধ। কোনো বিষয়ে অভিমত প্রকাশ করবেন না, অন্যয়ের প্রতিবাদ করবেন না। নারীরা কি মানুষ নয়? তাদের বসবাসযোগ্য পৃথিবী গড়ে তোলা আপনারও দায়িত্ব। কিন্তু যখন আপনি-আমি টু শব্দটিও করি না তবে অবশ্যই যার ওপর অন্যায় হচ্ছে তিনি কথা বলবেন। আর তার মতকে সমর্থন করলেও সেই ব্যক্তিরাও তার পাশে দাঁড়বেন। তাহলে নারীবাদ শব্দটিকে নিয়েই কেন এত ঘষামাজা, এত চর্চা?
সমাজের বৃহৎ অংশ এখন কূপমন্ডুকতায় বিশ্বাসী। তার গণ্ডির বাইরে গেলেই যেন সমাজ রসাতলে গেলো এরূপ চিত্র তার মনে দেখা দেয়। কিন্তু মানসিক প্রসারতা তাদের আর ঘটে না। অন্যায়কে অন্যায় বললেও তাদের গায়ে লাগে। খুব একটা স্বস্তি পান না। মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। নারীকেও মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করা জরুরি। আধুনিক যুগে এসেও যে আজ একথা বলতে হচ্ছে তা সত্যিই লজ্জাজনক! গড়ে উঠুক বিবেকসম্পন্ন মানুষ। ঘুচে যাক অন্ধকার।