দেশের প্রথম নারী বৈমানিক প্রশিক্ষক
একজন সাহসী নারী বৈমানিক ফারিয়া লারা। শুধু নিজেই যে আকাশে উড়তে চেয়েছেন তাই নয়। অন্যদেরও আকাশে ওড়ার প্রশিক্ষণ দিতেন তিনি। বৈমানিক হওয়ার মতো দুঃসাহস বর্তমান সময়েও খুব কম নারীরই রয়েছে। আজ থেকে ২৫-৩০ বছর আগে তো এ স্বপ্ন দেখাও যেন ছিল আকাশ-কুসুম কল্পনা। কিন্তু ফারিয়া লারা ছিলেন দুর্দান্ত এক সাহসী নারী। আকাশ জয় করার সাহস ছিলো তার প্রতিটি রক্তবিন্দুতে। কতটা সাহসী হলে মৃত্যুর ১৫ মিনিট আগে ইমার্জেন্সি কল দিয়ে কন্ট্রোলকে জানান ‘আমি আর কয়েক মিনিট বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে’।
‘মে ডে’ কল করার পর মাত্র কয়েক মিনিটই তিনি বেঁচে ছিলেন। ১৯৯৮ সালের আজকের এই দিনেই বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যুর কোলে ঢলে পরেছিলেন ফারিয়া লারা। ফারিয়া লারার জন্ম ঢাকায় ১৯৭০ সালের ১৬ এপ্রিল। তার মা কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন ও বাবা বাংলাদেশ বিমানের কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন খান।
ফারিয়া লারা ১৯৯২ সালে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক পাশ করেন। এর পরই তিনি বৈমানিক হওয়ার জন্য পাইলট প্রশিক্ষণে ভর্তি হন। ১৯৯৪ সালে লারা ইংরেজি সাহিত্যে এম এ পাশ করেন। ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬ সালে লারা সিভিল এভিয়েশন অথরিটি অব বাংলাদেশ থেকে প্রাইভেট পাইলটের লাইসেন্স অর্জন করেন। ১৯৯৮ সালের ১৯ মার্চ লারা বাণিজ্যিক পাইলট লাইসেন্স লাভ করেন। এরপরই তিনি পাইলটদের প্রশিক্ষক হওয়ার প্রশিক্ষণ নেন।
বাংলাদেশের প্রথম নারী পাইলট প্রশিক্ষক ছিলেন তিনি। পাইলট হতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেওয়ার পাশাপাশি উড্ডয়নের প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করেন। পঞ্চাশ ঘণ্টার এই প্রশিক্ষণের শেষ দিনটি ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ সালে বিমান দুর্ঘটনার সম্মুখীন হন। বরিশাল থেকে ঢাকায় ফেরার পর পোস্তগোলা এলাকায় সেসনা-১৫০ বিমানের কো-পাইলট সহ বিমান দুর্ঘটনায় তিনি নিহত হন।
অসম্ভব বিচক্ষণ ও মেধাবী ছিলেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই চমৎকার ছবি আঁকতেন। জাতীয়, আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কৃত হতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করার সময়ই আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থাপনা করে ব্যাপক প্রশংসিত হন। লিও ক্লারের সদস্য হিসেবে পৃথিবীর বহু দেশ ঘোরেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে অনার্স, এমএ করার সময় থেকে সাংবাদিকতা এবং লেখালেখিও শুরু করেছিলেন। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে গবেষণা, অনুবাদক ও দোভাষীর কাজও করেছেন।
ফারিয়া লারা ১৯৭৮ সালে কোরিয়ান চিলড্রেন সেন্টার পুরস্কার, ১৯৭৯ সালে ফিলিপস বাংলাদেশ পুরস্কার, ১৯৮০ সালে নিপ্পন টেলিভিশন নেটওর্য়াক আয়োজিত প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক, ১৯৮৪ সালে ভারতের শঙ্কর আন্তর্জাতিক পুরস্কার এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন আয়োজিত জাতীয় পর্যায়ে ‘নতুন কুঁড়ি’ প্রতিযোগিতায় উপস্থিত বক্তৃতায় পুরস্কার অর্জন করেন।
চাইলে বৈমানিক না হয়ে অন্য অনেক পেশায় নিজের নাম লেখাতে পারতেন। কিন্তু তিনি নিজের স্বপ্নের সঙ্গে আপোষ করতে ছিলেন নারাজ। তার ইচ্ছে ছিলো আকাশ ছুঁয়ে দেখার। ইচ্ছে পূরণও হয়েছিলো তার, কিন্তু আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন নিয়ে বিশাল আকাশের মধ্যেই হারিয়েছেন তার অস্তিত্ব। মাঝ আকাশে তার জীবন থেমে গেলেও তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়নি। আজও দেশবাসী স্মরণ করেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আত্মবিশ্বাসী এই নারীকে। বহু নারীর কাছে ফারিয়া লারা এক অনুপ্রেরণার নাম।