প্রীতিলতা: দেশপ্রেমে চিরকালীন প্রেরণার প্রতীক
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ভারতীয় জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী নেতা। দুঃখ- দারিদ্র্যের কষাঘাত যার মনোবল ও শক্তির কাছে নিমিষেই নতি স্বীকার করেছিল, তিনিই প্রীতিলতা। অদম্য মেধা, যোগ্যতা, দুঃসাহসিকতার মধ্যে দিয়ে পার করেছেন জীবনের প্রতিটি দুর্গম পথ। তিনি যে পথের দিশারী ছিলেন সাধারণ মানুষের পক্ষে, সে পথ অতিক্রম করা অনেকটাই দুঃসাধ্য! এই মহয়সী নারী স্বদেশের কল্যাণে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করতেও দ্বিধা করেননি।
প্রীতিলতার জন্ম ৫ মে ১৯১১ সালে তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের ধলঘাট, পটিয়া, চট্টগ্রামে। তার বাবা ছিলেন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানি। বাবার নাম জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার, মা প্রতিভাদেবী। ছয় সন্তানের মধ্যে জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রীতিলতা। তাদের পরিবারের আদি পদবী ছিল দাশগুপ্ত। পরিবারের কোনো এক পূর্বপুরুষ নবাবী আমলে ‘ওয়াহেদেদার’ উপাধি পেয়েছিলেন, এই ওয়াহেদেদার থেকে ওয়াদ্দেদার বা ওয়াদ্দার রূপেই পরবর্তী সময়ে দাশগুপ্তেরা পরিচিত হন।
শৈশবে বাবার মৃত্যুর পর জগদ্বন্ধু ওয়াদ্দেদার তার পৈতৃক বাড়ি ডেঙ্গাপাড়া সপরিবারে ত্যাগ করেন। প্রীতিলতার বেড়ে ওঠা পটিয়া থানার ধলঘাট গ্রামে মামার বাড়িতে । এখানেই প্রীতিলতার জন্ম হয়। তার ডাকনাম ‘রাণী’ । স্বাভাবে অন্তর্মুখী, লাজুক ও মুখচোরা হলেও প্রীতিলতা দেশের কল্যাণে খুবই সক্রিয় ছিলেন। প্রীতিলতার বক্তব্য ছিল-
‘স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে পারবো, প্রাণ নিতেও মায়া হবে না। কিন্তু নিরীহ জীব হত্যা করতে সত্যি মায়া হয়, পারবো না।’
প্রীতিলতার প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়। প্রতি ক্লাসে ভালো ফলের জন্য তিনি সব শিক্ষকের খুব প্রিয় ছিলেন। কিন্তু প্রীতিলতার সবচেয়ে পছন্দের ছিলেন ইতিহাসের শিক্ষক ঊষাদি। তিনি প্রীতিলতাকে পুরুষের বেশে ঝাঁসীর রানি লক্ষ্মীবাইয়ের সঙ্গে ইংরেজ সৈন্যদের লড়াইয়ের ইতিহাস বলতেন। শিক্ষকের মুখে শোনা বিপ্লবী কাহিনি প্রীতিলতাকে প্রচণ্ড পরিমাণে আকর্ষণ করেছিল।
স্কুলে পড়াকালীন সময়ে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে কল্পনা দত্তের সঙ্গে। পরবর্তীকালে তিনিও বিপ্লবীদের দলে নাম লেখান। শিক্ষকের কাছে শোনা সেই ঝাঁসীর রানিই তাদের চেতনাকে উদ্দীপ্ত করে এবং নিজেদের অকুতোভয় বিপ্লবী করে তোলার বাসনা জন্মে মনে।
১৯২৮ সালে কয়েকটি বিষয়ে লেটার মার্কস পেয়ে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করেন প্রীতিলতা। কিন্তু পরীক্ষার ফল দেওয়ার সময়টাতে তার বাড়িতে এক বিয়ের প্রস্তাব আসে। যদিও প্রীতিলতার প্রবল আপত্তির কারণে বিয়ের ব্যবস্থা তখনকার মতো স্থগিত হয়ে যায়। আই.এ. পড়ার জন্য তিনি ঢাকার ইডেন কলেজে ভর্তি হন। ১৯৩০ সালে আই.এ. পরীক্ষায় তিনি মেয়েদের মধ্যে প্রথম ও সবার মধ্যে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এই ফলের জন্য তিনি মাসিক ২০ টাকার বৃত্তি পেতে শুরু করেন। কলকাতার বেথুন কলেজে বি এ পড়তে যান। ১৯৩২ সালে ডিসটিংশান নিয়ে তিনি বি.এ. পাস করেন। কিন্তু, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে সম্পৃক্ত থাকায় কৃতিত্বের সঙ্গে স্নাতক পাস করলেও তিনি এবং তার সঙ্গী বীণা দাসগুপ্তর পরীক্ষার ফল স্থগিত রাখা হয়।
প্রীতিলতার বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক ধারায় হলেও মনের কোণে লালিত বিপ্লবী হয়ে ওঠার চেতনা তাকে সর্বদা জাগ্রত রেখেছিল। প্রীতিলতার নিকট আত্মীয় পূর্ণেন্দু দস্তিদার বিপ্লবী দলের কর্মী ছিলেন। তিনি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত কিছু বই প্রীতিলতার কাছে রাখেন। তখন তিনি দশম শ্রেণির ছাত্রী। বাঘাযতীন, কানাইলাল, দেশেরকথা, ক্ষুদিরাম তাদের সম্পর্কে জানতে শুরু করেন প্রীতিলতা। ফলে প্রীতিলতা মন আরও দৃঢ় হয়ে ওঠে। তাদের আদর্শে নিজেকেও বিপ্লবী করে তোলেন।
প্রীতিলতার জীবনাবসান ঘটে এভাবেই। কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অদম্য এই নারী দেশের জন্য লড়ে গেছেন। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আজকের দিনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই লড়াকু নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।
শৈশবে তিনি দেখেছেন মহাত্মা গান্ধীর অসহযোগ আন্দোলনে তখন চট্টগ্রাম সরগরম। বিপ্লবীরা প্রকাশ্য দিবালোকে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বাবদ নিয়ে যাওয়া টাকা ছিনতাই করেছে। দুই সপ্তাহ পর গোপন বৈঠকে অতর্কিত হামলায় সূর্য সেন ও অম্বিকা চক্রবর্তী গ্রেপ্তার হন। এই ঘটনা কিশোরী প্রীতিলতার মনে নানা প্রশ্নের জন্ম দেয়।
ইডেনে পড়াকালে প্রীতিলতা সঙ্গে পরিচয় ঘটে ‘শ্রীসংঘ’ নামে একটি বিপ্লবী সংগঠনের। এই দলটি প্রকাশ্যে লাঠিখেলা, কুস্তি, ডনবৈঠক, মুষ্টিযুদ্ধশিক্ষা ইত্যাদির জন্য ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় ক্লাব তৈরি করেছিল। ঢাকায় শ্রীসংঘের ‘দীপালী সঙ্ঘ’ নামে একটি মহিলা শাখা ছিল। লীলা নাগের এই সংগঠনটি নারীশিক্ষা প্রসারের জন্য কাজ করতো। গোপনে তারা মেয়েদের বিপ্লবী সংগঠনে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ ও করতো। ইডেন কলেজের শিক্ষক নীলিমাদির মাধ্যমে লীলা রায়ের সঙ্গে প্রীতিলতার পরিচয় হয়। তাদের অনুপ্রেরণায় দীপালী সঙ্ঘে যোগ দিয়ে প্রীতিলতা লাঠিখেলা, ছোরাখেলা ইত্যাদি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন।
প্রীতিলতা কলকাতা থেকে আসার একবছর আগে থেকেই কল্পনা দত্ত বেথুন কলেজ থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হন। সেজন্য প্রীতিলতার আগেই কল্পনা দত্তের সঙ্গে মাস্টারদার দেখা হয়। ১৯৩১ সালে এই গোপন সাক্ষাতের সময় আত্মগোপনে থাকা মাস্টারদার সঙ্গে ছিলেন বিপ্লবী নির্মল সেন, তারকেশ্বর দস্তিদার, শৈলেশ্বর চক্রবর্তী ও কালীকিংকর দে। মাস্টারদা ওই সাক্ষাতের সময় কল্পনা দত্তের কাছ থেকে প্রীতিলতা সম্পর্কিত খোঁজ খবর জানতে চান। এরমধ্যে একবার মাস্টারদার সংগঠন চালানোর জন্য জরুরি ভিত্তিতে কিছু অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়। প্রীতিলতার বাবা সংসারের খরচ চালানোর জন্য মাসিক বেতনের পুরো টাকাটা প্রীতিলতার হাতে দিতেন। তিনি ওই টাকাটা সংগঠনের কাজে দিয়ে দিতে চাইলেন। কিন্তু তা নিতে কল্পনা দত্ত আপত্তি করায় প্রীতিলতা কেঁদে বলেন, ‘গরিব দেখে আমাদের টাকা নিতে চান না। আমি যে নিষ্ঠাবান কর্মী হতে পারবো, তার প্রমাণ করার সুযোগও কি আমায় দেবেন না? নির্মল সেনের প্রশ্নের মুখে প্রীতিলতা duty to family কে duty to country র কাছে বলি দিতে পারবো বলে উত্তর দেন । পরবর্তী সময়ে সরাসরি বিপ্লবীদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অপরেশনে নামেন।
চট্টগ্রামে সূর্য সেনের কাছে বোমা পৌঁছে দিয়ে কলকাতা ফেরত যাওয়ার একদিন পরেই ২৪ নভেম্বর মনোরঞ্জন রায় পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। সে সময়ে টি জে ক্রেগ বাংলার ইন্সপেক্টর জেনারেল অফ পুলিশ পদে নতুন দায়িত্ব নিয়ে চট্টগ্রাম সফরে আসেন। তাকে হত্যা করার জন্য মাস্টারদা রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তীকে মনোনীত করলেন। পরিকল্পনা অনু্যায়ী ১৯৩০ সালের ২রা ডিসেম্বর চাঁদপুর রেলস্টেশনে তারা রিভলবার নিয়ে আক্রমণ চালায় কিন্তু ভুল করে তারা মি. ক্রেগের পরিবর্তে চাঁদপুরের এস ডি ও তারিণী মুখার্জিকে হত্যা করেন। সেদিনেই পুলিশ বোমা আর রিভলবার সহ রামকৃষ্ণ বিশ্বাস ও কালীপদ চক্রবর্তীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এই বোমাগুলোই কলকাতা থেকে মনোরঞ্জন রায় চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। তারিণী মুখার্জি হত্যা মামলার রায়ে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের মৃত্যুদণ্ড এবং কালীপদ চক্রবর্তীকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়। আলীপুর জেলের ফাঁসির সেলে মৃত্যু গ্রহণের প্রতীক্ষারত রামকৃষ্ণের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে আত্মীয়দের মধ্যে কেউ দেখা করতে আসা সম্ভব ছিল না। এ খবর জানার পর মনোরঞ্জন রায় প্রীতিলতার কাছে লেখা এক চিঠিতে রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করতে অনুরোধ করেন। প্রীতিলতা রামকৃষ্ণের কাজিন পরিচয়ে অমিতা দাস ছদ্মনামে চল্লিশ বার কারাগারে দেখা করেন। রামকৃষ্ণের ফাঁসির পর বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে আরও বেগবান হয়। সে সময় মাস্টার দা সূর্যসেনের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে বিশেষভাবে। বিপ্লবীদের কাছ থেকে তার ছবি সংগ্রহ করলে একসময় মাস্টার দা তাকে আত্মগোপনের নির্দেশ দেন। তিনি ওই সময় আত্মগোপন করলেও দেশের জন্য তাকে আবারও সম্মুখে আসতে হয়। একের পর এক প্রতিরোধ গড়ে তোলেন শত্রুর বিপক্ষে।
১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল যখন চট্টগ্রামের বিপ্লবীরা যেসব কর্মসূচি নিয়েছিলেন,তার মধ্যে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ অন্যতম ছিল। তরুণ বিপ্লবী শৈলেশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একদল বিপ্লবীকে ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। এ আক্রমণ ব্যর্থ হয়, ব্যর্থতার বেদনা সহ্য করতে না পারায় শৈলেশ্বর চক্রবর্তী আত্মহত্যা করে। অতঃপর সূর্যসেন সিদ্ধান্ত নেন আক্রমণের দায়িত্ব একজন নারীকে দেবেন, তিনি বলেছিলেন বাংলায় বীর যুবকের আজ অভাব নেই।
প্রীতিলতা হুইসেল বাজিয়ে আক্রমণ শুরুর নির্দেশ দেওয়ার পরেই ঘন ঘন গুলি আর বোমার আঘাতে পুরো ক্লাব কেঁপে ওঠে। ক্লাবঘরের সব বাতি নিভে যাওয়ার কারণে সবাই অন্ধকারে ছোটোছুটি করতে শুরু করে। কিন্তু ক্লাবে কয়েকজন ইংরেজ অফিসারের কাছে রিভলবার থাকার কারণে তারাও পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করে। একজন মিলিটারি অফিসারের রিভলবারের গুলিতে প্রীতিলতার বাম-পাশে গুলির আঘাত লাগে। প্রীতিলতার নির্দেশে আক্রমণ শেষ হলে বিপ্লবী দলটার সঙ্গে তিনি কিছুদূর এগিয়ে আসেন। পুলিশের রিপোর্ট অনুযায়ী সেদিনের এই আক্রমণে মিসেস সুলিভান নামে একজন নিহত হয়, চার জন পুরুষ ও সাত জন মহিলা আহত হয়।
ইউরোপীয় ক্লাব আক্রমণে অংশ নেওয়া অন্য বিপ্লবীদের দ্রুত স্থান ত্যাগ করার নির্দেশ দেন প্রীতিলতা। পূর্ব-সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পটাসিয়াম সায়ানাইড খেয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া প্রীতিলতাকে বিপ্লবী শ্রদ্ধা জানিয়ে সবাই স্থান ত্যাগ করে। পরদিন পুলিশ ক্লাব থেকে ১০০ গজ দূরে মৃতদেহ দেখে পরবর্তী সময়ে প্রীতিলতাকে শনাক্ত করেন। তার মৃতদেহ তল্লাশির পর বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলবারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি ও একটা হুঁইসেল পাওয়া যায়। ময়না তদন্তের পর জানা যায় গুলির আঘাত তেমন গুরুতর ছিল না, পটাশিয়াম সায়ানাইড ছিল তার মৃত্যুর কারণ।
প্রীতিলতার জীবনাবসান ঘটে এভাবেই। কিন্তু শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত অদম্য এই নারী দেশের জন্য লড়ে গেছেন। ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আজকের দিনে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই লড়াকু নারীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা।