পেশা নির্বাচনে নারী কতটা স্বাধীন
শিক্ষা-দীক্ষা-জ্ঞান-বিজ্ঞানে সারাবিশ্ব এগিয়ে গেলেও বাঙালি সমাজে নারীর পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা আসেনি। সচেতন মহলের অভিযোগ, নারীকে এখনো গৃহকর্মে ব্যস্ত রাখতেই পুরুষতন্ত্রের যত ষড়যন্ত্র, যত নীলনকশা। শিক্ষকতা, নার্সিং কিংবা ডাক্তারির বাইরে তাকে অন্য কোনো চ্যালেঞ্জিং পেশা বেছে নিতে গেলে সমাজ ‘গেলো’-‘গেলো’ বলে তেড়ে আসে। পদে পদে নারীকে বাধা দেয়। নারীর জন্য সমাজে কোনো সুরক্ষাবলয় এখনো গড়ে ওঠেনি। এই বিষয়ে অনন্যার মুখোমুখি হয়েছেন দেশের কয়েকজন বিশিষ্ট শিক্ষক, সাহিত্যিক ও সমাজকর্মী।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রোজী আহমেদ বলেন, ‘পরিবর্তনের এই যুগে নারীর অবস্থান আজ অনেকটাই দৃঢ়। শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের ফল পুরুষকে পেছনে ফেলছে। কিন্তু কর্ম নির্বাচনে তারা বেশিরভাগ সময় এগিয়ে থাকতে পারছেন না। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, পেশা নির্বাচনে নারী কি স্বাধীন? উত্তর অবশ্যই না। বিজ্ঞানের জটিল সূত্র আবিষ্কার, মহাকাশ জয়, সরকারের নীতি-নির্ধারণী কর্মপন্থাসহ সব কাজেই নারীর অংশগ্রহণ আছে। তবে, তা কি যথেষ্ট? জীবনের শুরু থেকেই কন্যাসন্তানকে অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়। ছেলে শিশুকে পিস্তল দিয়ে খেলতে দিলেও মেয়ে শিশুর জন্য থাকে পুতুল। একটু বড় ছেলে শিশুকে যেখানে দোকান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাইরে পাঠানো হয়, সেখানে মেয়েদের ঘর গোছানোর মতো অভ্যন্তরীণ কাজে সম্পৃক্ত করা হয়।’
রোজী আহমেদ বলেন, ‘প্রত্যেক পরিবারের উচিত নারীকে স্বাধীন মতপ্রকাশের পাশাপাশি পেশা নির্বাচনে স্বাধীনতা দেওয়া। কিন্তু বাল্যকাল থেকেই ছেলে-মেয়ের মধ্যে যে বিভেদ পরিবার তৈরি করে, তারই পরিপ্রেক্ষিতে মেয়ে শিশুরা নিজের স্বাধীন ইচ্ছা শক্তিকে দমন করতে বাধ্য হয়। প্রাপ্তবয়স্ক হয়েও তারা এই বৃত্তের বাইরে যাওয়ার জন্য সংকল্পে দৃঢ় হতে পারে না। কারণ সমাজ ও পরিবার দীর্ঘদিন ধরে নানাভাবে তাদের মস্তিষ্কে সঞ্চারিত করে আসছে, তুমি নারী, তোমার জন্য বাইরের পৃথিবী নিরাপদ নয়, নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা তোমার নেই। ফলে শারীরিক ও মানসিক; উভয় দিক দিয়ে অবদমনের শিকার হয়ে অধিকাংশ নারী চ্যালেঞ্জিং কাজকে এড়িয়ে চলেন।’
এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘শিক্ষকতা ও ডাক্তারি পেশায় তাদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়। আমি মনে করি, সমাজে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, এই বৃহৎ জাতিকে সব পেশায় দায়িত্ব পালনে উদ্বুদ্ধ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করার সুযোগ সৃষ্টি করাই এখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।’
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আয়েশা আক্তার বলেন, ‘আজকের সমাজে বেশির ভাগ নারী তার নিজের পছন্দ মতো পেশা নির্বাচনের সুযোগ পাচ্ছেন। আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে গত দুই দশকের পরিসংখ্যান যদি দেখি, কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ দিনে দিনে বেড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার তথ্য মতে, ১৯৯০-এর পর থেকে কর্মসংস্থানের বিভিন্ন স্তরে বাংলাদেশে নারীদের অংশগ্রহণ উল্ল্যেখযোগ্য হারে বেড়েছে। যা বর্তমানে প্রায় ৩৪.৮৯ শতাংশেরও বেশি। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একজন শিক্ষিত নারী স্বাভাবিকভাবেই আত্মসচেতন, আর একজন সচেতন নারী তার নিজের সপ্ন ও ইচ্ছাকে বাস্তবে রূপ দিতে সচেষ্ট থাকে। এ ক্ষেত্রে অনেক সময় দেখা যায়, বিশাল জনগোষ্ঠী, সীমিত কাজের সুযোগ ও তীব্র প্রতিযোগিতার কারণে নারী তার কাঙ্ক্ষিত কাজটি করার সুযোগ কম পাচ্ছে। কিন্তু পেশা নির্বাচনে আজকের নারীরা পুরোপুরি স্বাধীন, তা বলা যায় না।’
আয়েশা আক্তার বলেন, ‘কাজের জন্য পরিবার থেকে দূরে থাকা, ঝুঁকিপূর্ণ ও অনিরাপদ কাজগুলোতে নিরাপত্তার কথা ভেবে এখনো বিভিন্ন পরিবার নারীকে নিরুৎসাহিত করে। তবে অর্থনৈতিক টানাপড়েন, সামাজিক ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে নারীরা এখন বিভিন্ন পেশা বেছে নিচ্ছেন। আজকাল আমাদের দেশের নারীদের প্রয়োজন কিংবা শখের বশেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টটাইম কাজ করতে দেখা যায়, যা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নারী নিজের পছন্দেই করে। এছাড়া, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন,অর্থনীতিতে নারী পুরুষের সহাবস্থানের কারণে বর্তমানে নারীরা আগের তুলনায় বেশি স্বাধীনতা পাচ্ছে।’
সাহিত্যিক নাসরিন জে রানি বলেন, ‘পেশা নির্বাচনে বাংলাদেশি নারীরা পুরুষের চেয়ে বেশি স্বাধীন। এই দেশে সচ্ছল পরিবারের উচ্চশিক্ষিত নারীদের মাঝে অধিকাংশের প্রিয় পেশা ঘর-সামলানো বা গৃহিনী হওয়া। অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ভালো চাকরি করছেন, কিন্তু সময় গড়িয়ে বয়েস একটু বেড়েছে বা কর্মক্ষেত্রে সামান্য চ্যালেঞ্জ এসেছে, তাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরে থাকছেন। কিন্তু পুরুষরা এই দিক দিয়ে সৌভাগ্যবান। কেননা নারীদের ঘর ও অফিস বা ব্যবসা দুটোই সামলাতে হয়, যা সিংহভাগ পুরুষের ক্ষেত্রে ভিন্ন রকম বা এই ধরনের দায়িত্ব থেকে মুক্ত থেকে শুধু বাইরের কাজটুকু অর্থাৎ অর্থ উপার্জনের কাজটি নিয়েই ব্যস্ত থাকতে পারে তারা। এরবাইরে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে,
এই সমাজের নারীরা পড়াশোনা তেমন গুরুত্ব দিয়ে করতে আগ্রহী নন, যতটুকুই বা করছেন, তার মাঝে বেশিরভাগের প্রবণতা থাকে, একটি ভালো পরিবারসহ চমৎকার ক্যারিয়ারের একজন পুরুষের সঙ্গে বিয়ে হওয়া ও নিরাপদ জীবনযাপন করা। পাশাপাশি সুযোগ পেলে খণ্ডকালীন কিছু করা বা না করলেও চলে।’
এই সাহিত্যিক আরও বলেন, ‘নিম্নবিত্ত শ্রেণিতে দৃশ্যটি সামান্য ভিন্ন রকমের। সেখানে মেয়েরা পড়াশোনার সুযোগ কম পায়, অর্থাভাবের কারণে অল্প বয়েসে বিয়ে হয়ে যায়। ইচ্ছে না থাকলেও বাইরে কাজ করতে হয়। পাশাপাশি সংসার ও কাজ; দুটোই সামলাতে হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়েরা পেশা নিয়ে ভাবনায় তেমন সচেতন নন, যদিও অনেকেই আজকাল চাকরি করছেন, স্ব-স্ব পেশা ক্ষেত্রে ভালো উন্নতি করছেন, কিন্তু সার্বিক চিত্রে তার প্রাধান্য বা উপস্থিতি বেশ কম, তাদের অনেকেই বিয়ের পরে উপযুক্ত সময়মতো একটি বা দুটি বাচ্চা নেওয়ার পরে ডিলেমায় ফেঁসে গিয়ে পেশার চেয়ে বাচ্চাপালনের দিকে ঝোঁক বেশি হয় বা চাপ বেশি আসে। তেমনটাই নজরে পড়ে৷ তবু পেশার স্বাধীনতা মোটামুটি ছেলে-মেয়ের গড় হিসেবেই হাজির আছে এই সমাজের সবশ্রেণিতেই।’
তরুণ সমাজকর্মী মৌ হালদার দূর্বা বলেন, ‘নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া থেকে শুরু করে বর্তমান সমাজবিজ্ঞানী হয়ে আজকের নারীবাদীগণ; সবাই একথা একবাক্যে স্বীকার করেন, নারী মুক্তির প্রথম সোপান হলো নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি। কিন্তু রক্ষণশীল বাঙালি সমাজ নারী চিকিৎসক, নারী শিক্ষক যতখানি খোঁজেন, নিজের কন্যাসন্তানটিকে উচ্চশিক্ষায় দীক্ষিত করতে ততখানি আগ্রহী নন। বিয়ের বাজারে এইসএসসি পাস থেকে অনার্সে পড়া মেয়েদের চল থাকে সবচেয়ে বেশি। একেবারে অশিক্ষিত হলে সামাজিক মানমর্যাদা থাকে না। তাই অভিভাবকরা কোনোক্রমে কন্যাকে অক্ষরজ্ঞান দিয়ে পরের ঘরে পাঠাতে পারলেই নিজের দায়িত্ব কর্তব্যের ভার হালকা হল মনে করেন। সুতরাং পেশা বেছে নেওয়ার প্রথম ধাপেই নারীরা পিছিয়ে পড়েন। কারণ অভিভাবকরা তাদের পেছনে অনর্থক অতিরিক্ত টাকা খরচে আগ্রহী নন৷’
মৌ হালদার দূর্বা বলেন, ‘‘বর্তমানে কিছু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত নব্য আধুনিক পরিবার চান যে, তাদের ঘরের বউটি চাকরিজীবী হোন,যেন ‘দেখ আমরা কতটা প্রগতিশীল’; একথা বলে তারা আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলতে পারেন। কিন্তু সেই চাকরি বা পেশা এমন হতে হবে, যেন ঘরের কাজকর্মে কোনোভাবেই কোনো ত্রুটি না হয়। সুতরাং পেশাজীবী নারীকে সংসার জীবনে অধিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। কেউ পছন্দের পেশা পরিবর্তন করেন কেউ বা সন্তান জন্মদানের পর চাকরি ছাড়তে বাধ্য হন। কারণ উন্নত বিশ্বের মতো আমরা নারীকে ঘরের বাইরে বেরুতে তো হতে বলছি কিন্তু শিশু পরিচর্যা বা রক্ষণাবেক্ষণ কেন্দ্র তেমন গড়ে ওঠেনি তাদের মতো।’’
এই তরুণী আরও বলেন, ‘বর্তমানে অনেক নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে চাইছেন। সেখানেও সামাজিক অজ্ঞতার কারণে তারা হেয় হচ্ছেন। কখনো বা পুঁজির অভাবে পিছিয়ে যাচ্ছেন। নারীর যে অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন সামাজিক মুক্তির জন্য, অধিকাংশ সময়ই তা অন্যের সিদ্ধান্ত দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে৷ তবে আশার কথা এই যে অপ্রতুল হলেও কিছু পরিবার প্রাচীন ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত হয়ে নারীকে সহায়তা করছে, তার পছন্দমতো পেশা ও জীবন বেছে নেওয়ার। কোনো কোনো নারী ভাঙছেন সব প্রতিকূলতার কঠিন দরজা৷’
লেখক প্রিয়তু শ্যামা বলেন, ‘‘কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ এই অমর উক্তিটিকে আমার কাছে মাঝে মাঝে বড় বেশি কাগুজে মনে হয়। কাজী নজরুল যে মানসিকতা থেকে ওই সময় এমন কথা ভাবতে পেরেছিলেন, আজকের পৃথিবীতে এসেও এর সঠিক কার্যকরী দৃষ্টান্ত আমাদের চারপাশে দেখতে পাচ্ছি না। আমাদের পড়াশোনার শুরুতেই ভাবতে হয়, আমরা কোন কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে পারি, আই মিন কোন কোন সাবজেক্ট নিয়ে পড়লে চাকরির বাজারে সেইফ সাইডে থেকে পেশা নির্বাচন করতে পারবো। এছাড়া আমাদের পড়তে যাওয়ার আগে এ-ও ভাবতে হয়, নিজ শহর বা এলাকার বাইরে যাবো কি-না। আর এর একটাই কারণ, সেটা হলো আমাদের সুরক্ষা।’’
প্রিয়তু শ্যামা আরও বলেন, ‘‘আমরা পেশা নির্বাচন করতে প্রথমেই ধাক্কা খাই নিজেদের সুরক্ষিত রাখা নিয়েই। পরিবার চিন্তা করে, ‘আগে তো আমার মেয়ে মানসম্মান নিয়ে বাঁচুক,পরে পড়াশোনা, চাকরি, ক্যারিয়ার।’ অথচ পত্রিকা খুললেই দেখতে পাই নারী ক্রিকেটার, ফুটবলাররা পুরুষের চেয়ে অনেকাংশে ভালো করছে। নারী ভার-উত্তোলন করতে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে না তার গড়নের কারণে। নারী অবলীলায় এভারেস্ট জয় করছে, প্লেন চালাচ্ছে। তার মানে নারীর সক্ষমতা আছে সর্বক্ষেত্রেই। যা নেই তা হলো সুস্থ স্বাভাবিক একটা পরিবেশ, আর দৃষ্টিভঙ্গির উদারতা। এখনো নারীকে শরীরসর্বস্ব জীব হিসেবেই দেখা হয়। নারীর যত বাধা আমি মনে করি, তার সবটাই পারিপার্শ্বিক অবস্থার কারণে। সমাজের আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থা উন্নত করতে পারলেই নারী পেশা নির্বাচন করার ক্ষেত্রে স্বচ্ছন্দ হতে পারতো।’