প্রমীলা খেলোয়াড়
একসময়ের জাতীয় আবেগ ক্রিকেট। একসময় বলার পেছনে কারণ কী? বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাম্প্রতিক পারফর্মেন্স দেশের মানুষের আবেগ অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে। প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল না পাওয়ার বিষয়টি দুঃখজনক।
অভিযোগ আছে, জাতীয় ক্রিকেট দলের পুরুষরা ম্যাচপ্রতি যে সম্মানী পেয়ে থাকেন তার কারণে অনেক খেলোয়াড়ই আর পরিশ্রমের ধার ধারেন না। এমন যুক্তি অবশ্য মেনে নেওয়ার কারণ নেই। বলা যেতে পারে জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে এক ধরনের মানসিক আকাঙ্ক্ষার অভাব আছে। সেজন্যে আন্তর্জাতিক পরিসরে তারা প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল করতে পারছেন না। উল্টোচিত্র দেখা যায় প্রমীলা খেলোয়াড়দের দিকে তাকালে। ক্রীড়াঙ্গনে নারীর অংশগ্রহণ সম্প্রতি এক নতুন মাত্রা পেয়েছে।
নারী জাতীয় ক্রিকেট দল তো বহুদিন ধরেই চমক দেখিয়ে চলেছে। নারীদের এশিয়া কাপ জয় সারাদেশের মানুষকেই চমকে দিয়েছিল। ফলে ক্রীড়াঙ্গনে ব্যর্থতা অর্থাৎ ক্রিকেটে পুরুষ দলের একের পর একের হারের স্বাভাবিক কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়েছিল। শুধু ক্রিকেট কেন? প্রায় প্রতিটি ক্রীড়াঙ্গনেই নারীর অংশগ্রহণ ও অর্জন যেন সমাজকে নতুন বার্তা দিতে শুরু করেছে। নারী চাইলেই পারে।
এইতো কিছুদিন আগে সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ মহিলা ফুটবল দল প্রতিটি ম্যাচে যেভাবে গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন তা দেখে স্তম্ভিত না হয়ে থাকার উপায় নেই। দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় প্রতিটি দলকে পাত্তাই দেয়নি বাংলাদেশ। এমনকি এই সময়ে প্রতিপক্ষের জালে বল জড়িয়ে দিলেও প্রতিপক্ষরা সান্তনাসূচক গোল ছিনিয়ে নিতে পারেনি। এতটাই আক্রমণাত্মক ছিল বাংলাদেশের প্রমীলা দল।
আমরা দেখেছি নারী দলকে শুভকামনা জানাতে মাঠে উপস্থিত ছিলেন অনেক দর্শক। তারা একবারও কিন্তু ভাবেননি মেয়েরা ফুটবল খেলছে। দর্শকদের আগমন যে সামাজিক পরিবর্তনের দিকে ইঙ্গিত করে তা ইতিবাচক। নারী এখন ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠতে পারেন। এর আগেও আমরা দেখেছি আইসিসির প্যানেল রেফারি হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন একজন নারী। নারীরা ক্রীড়াক্ষেত্রে যে সাফল্য দেখিয়ে চলেছেন তার তুলনায় পুরুষদের অর্জন অনেকটাই ফিঁকে হয়ে আছে। অবশ্য পুরুষ দলকে ঘিরেই দেশের প্রত্যাশা থাকে বেশি। নারীদের অর্জন সামাজিকভাবেই রাখা হয় সবার অলক্ষ্যে। কিন্তু যখন নারীর জন্যে সুযোগের দ্বার খুলে যেতে শুরু করে তখন তা রুদ্ধ করা কঠিন বৈকি। ইতিহাস তেমন সাক্ষ্যই দেয়। ফুটবল বিশ্বকাপ জয় করবে এমন সাহস কোনো এশীয় দল করতে না পারলেও জাপান কিন্তু নারী বিশ্বকাপ জয় করেছে। ক্রীড়াক্ষেত্রে নারীর অর্জনকে তাই ছোট করে দেখার অবকাশ নেই।
সমগ্র বিশ্ব বাদ দিলাম। আমাদের দেশের গেল এক দশকের ক্রীড়াঙ্গনে নারীর দাপট চোখ এড়ানোর সুযোগ নেই। নারী এখন পাদ-প্রদীপের আলোয় থেকে সান্ত্বনা কুড়োচ্ছেন না। ক্রীড়াক্ষেত্রে সিংহভাগ অর্জন তাদের খেরোখাতায়। এই তালিকা করলে যেমনটা আগেও বলেছি, ক্রিকেট ও ফুটবল থাকবে সবার ওপরে। দলগত সাফল্য বাদে ব্যক্তিগত সাফল্যের পাল্লাতেও পিছিয়ে নেই নারী। সাঁতারু মাহফুজা খাতুন শিলা, দাবাড়ু শারমিন সুলতানা শিরিন, আর্চার ইতি খাতুন, ভারোত্তলক মাবিয়া আক্তার সীমান্ত প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল ডিঙিয়ে দেশ-বিদেশে সুনাম কুড়িয়ে চলেছেন। অনেকেই মনে করেন, নারীদের ক্রীড়ায় আর তেমন কষ্ট কোথায়?
আবার অনেকে এও মনে করেন, ক্রীড়াঙ্গনে নারীর সাফল্য মূলত প্রতিযোগিতার তীব্রতা কম হওয়ায়। প্রশ্ন হচ্ছে, যেখানে প্রতিযোগিতা নারীতে নারীতে সেখানে এমন অভিযোগ তোলাটা অযৌক্তিক নয় কি? পুরুষ ও নারী দ্বৈত হয় এমন বেশ কিছু খেলা যেমন টেনিস কিংবা ব্যাডমিন্টনেও নারী খেলোয়াড়দের অংশগ্রহণ আছে। বিশেষত কারাতে ও ফেন্সিং এর মতো খেলাতেও নারীরা বেশ এগিয়ে। এছাড়া শারীরিক শক্তিমত্তার প্রশ্নে ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ এখানে কম ও এ বিষয়ে আমার ধারণা বেশ কম। কিন্তু এটুকু অন্তত সবাই মেনে নিতে পারেন বলেই আমার ধারণা।
যাহোক, শারীরিক শক্তিমত্তা প্রদর্শন করতে হয় এমন খেলাতেও নারীর অংশগ্রহণ আছে। কারাতে ও জুডোতে তো নারীর অংশগ্রহণ বেশ পুরোনো। সম্প্রতি বাংলাদেশ রাগবি খেলা শুরু করেছে। সেখানে পুরুষ দল নতুন করে পথচলা শুরু করেছে। অথচ মাত্র একুশ বছর বয়সেই বাংলাদেশের প্রথম নারী রাগবি রেফারি হয়েছেন আজমিরা আক্তার। স্বীকৃত রাগবী খেলোয়াড় হিসেবেও তার সুনাম রয়েছে। এভাবে উদাহরণ টানতে শুরু করলে ভুড়ি ভুড়ি গল্প পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের আলোচনার প্রসঙ্গ তা নয়।
পুরুষ দলের অর্জন বা সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন করা এই আলোচনার উদ্দেশ্য নয়। মূলত প্রমীলা খেলোয়াড়দের প্রতিবন্ধকতা ও ক্রীড়াঙ্গনের নারীর সাফল্য যে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয় তাকেই আমরা বিশ্লেষণ করতে চাই। যেমনটা বলেছি, আন্তর্জাতিক মঞ্চে নৈপুণ্য দেখানো নারী ক্রীড়াবিদের তালিকা বেশ দীর্ঘ। দেশের জন্য তারা নানাভাবে গৌরবের উপলক্ষ এনে দিয়েছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীকে অতিক্রম করতে হয়েছে প্রতিবন্ধকতার বেড়াজাল। সেসব লড়াইয়ের গল্প হৃদয়কে নাড়া দিয়ে যায়। একই সঙ্গে উঠতি ক্রীড়াবিদদের গল্প আত্নবিশ্বাসের রসদ যোগায়। আমাদের স্মরণে আছে ময়মনসিংহের প্রত্যন্ত অঞ্চলের কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেয়েরা পরিবারকে বোঝাতে পেরেছে তারা খেলাধুলা করবে।
তাদের এই আত্মবিশ্বাস ও নিজেকে মেলে ধরার যে সাহসিকতা তা আধুনিক মননকে বিভিন্নভাবে হার মানাতে সক্ষম। দেশের নারী ফুটবল ইতিহাস রাতারাতি বদলে গেছে এই সামান্য ঘটনায়। গণমাধ্যমের কল্যাণে সেই উদাহরণ দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আশার আলো ছড়িয়েছে। সামাজিক পরিবর্তন ও নারীর প্রতিষ্ঠার নতুন পথ খুলে দিয়েছে ক্রীড়াঙ্গন। অথচ প্রতিষ্ঠা অর্জনের জন্য নারী আর যাই হোক ক্রীড়াঙ্গনে আসবে এমনটা কেউ এক দশক আগে ভাবতেও পারতো না।
এখনও যে ভাবতে পারে এমন না। পুরুষ জাতীয় দলে যেভাবে অনেক স্পন্সর বা সম্মানী মেলে তার সামান্য অংশও নারীরা পান কিনা সন্দেহ আছে। একবার একটি সংবাদসূত্রে জানতে পেরেছি, জাতীয় লিগে প্রথম স্তরে খেলা এক নারী খেলোয়াড় পান মোটে ৬০০ টাকা। অথচ একজন পুরুষ খেলোয়াড় পান ২৫ হাজার টাকা। পার্থক্যের অনুপাত কত বড় একবার ভেবে দেখুন। অথচ খেলার সরঞ্জাম কিংবা অন্যান্য খরচ কিন্তু কারোই কম হওয়ার কথা নয়। তবুও নারীরা অংশগ্রহণ করছে। কেউ সমাজের প্রতিবন্ধকতাকে পাশ কাটিয়ে আবার কেউ অনুপ্রেরণা পেয়ে। হ্যাঁ, এখন অনেকের অভিভাবক তার মেয়েকে ক্রীড়াঙ্গনে স্বেচ্ছায় পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। এমন দৃষ্টিভঙ্গিকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
তাই বলে ক্রীড়াঙ্গনে নারীর সুযোগ-সুবিধা যে অপ্রতুল তা এড়িয়ে যাওয়ার অবকাশ নেই। শুধু পরিচর্যার অভাবে ক্রীড়াঙ্গন থেকে হারিয়ে গেছে এমন নজির শুধু নারীর ক্ষেত্রেই নয় পুরুষদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু প্রমীলা খেলোয়াড়দের সম্মানী, সুযোগ-সুবিধা, পরিচর্যা, প্রশিক্ষণ সুবিধা ইত্যাদি বিষয় যদি বিবেচনায় আনি তাহলে একটি বিষয় স্পষ্ট – নারীদের অনেকটাই দমিয়ে রাখা হয়েছে। অবশ্য এর পেছনেও কিছু কারণ আমরা খুঁজে পাই। প্রমীলা দলের খেলায় দর্শকই বা কত হয়? অবশ্য এখন সেই চিত্রও বদলে গেছে। নারীদের নিয়েও নানা ফ্র্যাঞ্চাইজ লিগ আয়োজিত হচ্ছে। নারীও স্পন্সর পাচ্ছে। কিন্তু জাতীয়ভাবে ক্রীড়াঙ্গনকে আরো সহজ করার বিষয়টি রয়ে গেছে অন্ধকারে।
গেল দশকের সাফল্য কিংবা নারীর উন্নতিতে উৎসাহিত হওয়ার অনেক কারণ রয়েছে। তবু আমাদের সামনে এক বিরাট ও কঠিন প্রশ্ন ঠিকই রয়ে গেছে। বর্তমানে ক্রীড়াঙ্গনে যে কাঠামো ও পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তাতে কি নারী ক্রীড়াঙ্গনকে পেশা হিসেবে ভাবার সুযোগ পাচ্ছেন? এখনও পেশাদার খেলোয়াড় গঠনের অবকাঠামো কি আমরা নিশ্চিত করতে পেরেছি? আর কতদিন নারী নিজ উদ্যমে, প্রতিভায় ও প্রচেষ্টায় সাফল্যের শিখরে পৌঁছুবেন? অবকাঠামো উন্নয়নের মূল লক্ষ্যই হলো কাউকে দক্ষ করে তোলা। কারো উদ্যম থাকলেও যথাযথ প্রতিভা নাও থাকতে পারে। কিন্তু প্রতিভাই সবকিছুর উত্তর নয়। দক্ষ করে তোলার মাধ্যমেও উন্নতি সম্ভব। তাই এখন থেকেই নারী ও পুরুষ খেলোয়াড়দের মধ্যে যেন বেতন বৈষম্য না থাকে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীলদের মনোযোগী হতে হবে। সর্বোপরি ক্রীড়াঙ্গনকে নারীর জন্য সর্বোচ্চ নিরাপদ স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান প্রমীলা খেলোয়াড়দের সাফল্য দেশের জন্য যে শুভ ইঙ্গিত বহন করে তাকে অবহেলা করাটা হবে বিরাট ভুল।
অনন্যা/এআই