Skip to content

১১ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ২৬শে আশ্বিন, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শাহ আব্দুল করিমের গান: নারী প্রসঙ্গে

বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম (১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯১৬-১২ সেপ্টেম্বর ২০০৯) ছিলেন বাউল গানের একনিষ্ঠ সাধক। বাংলা বাউল গানকে তিনি বাণী ও সুরের জালে শিল্পের তুরীয় মার্গে নিয়ে গেছেন। তার আগে অবশ্যই লালন ফকির (১৭ অক্টোবর ১৭৭৪–১৭ অক্টোবর ১৮৯০) বাউল গানকে করে তুলেছিলেন আধ্যাত্ম-সাধনার মন্ত্রের মতো। বর্তমান নিবন্ধের আলোচ্য বিষয় সমগ্র বাউল গান  নয়—কেবল শাহ আব্দুল করিমের নারীজীবন চিত্রিত হয়েছে, এমন গান।

শাহ আব্দুল করিম ৫ শতাধিক গান রচনা করেছেন। তাঁর প্রকাশিত গানের বই ৮টি। এগুলো হলো, ‘আফতাব সঙ্গীত’ (১৩৫৫ বাংলা; আনুমানিক ১৯৪৮); ‘গণসঙ্গীত’ (১৯৫৭); কালনীর ঢেউ (১৩৮৮ বঙ্গাব্দ; ১৯৮১); ধলমেলা (১৩৯৬ বঙ্গাব্দ; ১৯৯০); ভাটির চিঠি (১৪০৫; ১৯৯৮); কালনীর কূলে (নভেম্বর ২০০১) ও শাহ আব্দুল করিম রচনাসমগ্র (সংকলন ও গ্রন্থন: শুভেন্দু ইমাম, ২০০৯)। এসব  গানে যেমন দেহতত্ত্ব, আধ্যাত্মিকতার কথা বলা হয়েছে, তেমনি বর্ণনা করা হয়েছে  দেশপ্রেম-মানবপ্রেমও। তিনি বাউল সাধক হলেও আধুনিক কবিদের মতো তার গানে দেশপ্রেমও ফুটে উঠেছে। একইসঙ্গে তিনি মানবজীবনের নানা পর্বের বর্ণনা দিতে গিয়ে একইসঙ্গে লোককবি ও আধুনিক কবিদের মতো নস্টালজিকও হয়ে পড়েছেন। হয়তো এ কারণে শাহ আবদুল করি একইসঙ্গে বাউলগানপ্রেমী ও আধুনিক গানের শ্রোতাদের কাছে সমানভাবে সমাদৃত।

বাউল গানে সাধারণত নারীকে সাধনসঙ্গী বিবেচনা করা হয়। আর প্রচলিত ধর্মগুলো নারীর যেসব বিষয়কে অপবিত্র বলে ঘোষণা করে, বাউলতত্ত্বে সেসব বিষয়কে পবিত্র ও নারীর অসীম শক্তির আধার বিবেচনা করা হয়। যেমন, ঋতুস্রাব। মাসের নির্দিষ্ট কদিন ঋতুস্রাবের সময়টুকুয় নারীর শরীর অপবিত্র বলে ঘোষণা করেছে প্রচলিত ঐশী ধর্মগুলো। কিন্তু বাউলতত্ত্ব বলছে—‘না’। এই সময়ই হলো নারীর অপরিমেয় শক্তিমত্তা প্রকাশের কাল। এই সময়ে নারী অধিক পূজনীয়। এছাড়া বাউল গানে নারীকে কখনো তুচ্ছ করে দেখা হয় না, বরং শক্তির উৎস ও আধ্যাত্ম সাধনার কেন্দ্রও মনে করা হয়।

বাউল তত্ত্বের এই প্রচলিত নিয়মের বাউরেও শাহ আব্দুল করিমের নারীবিষয়ক গানের আরও একটি বার্তা আছে। সেটি আধুনিক ও লোককবিদের মতো নারীকে কামনা-বাসনাযুক্ত রক্তমাংসের সামাজিক প্রাণী হিসেবেই দেখা। তাই তাঁর গানে নারী কেবল আধ্যাত্ম সাধনায় মগ্ন থাকে না। নারী তার প্রেমিক পুরুষকে কামনা করে, নিজেকে সমর্পণ করে কামনায়-বাসনায়। আর একটি কথা, এই নারীবিষয়ক বাউল গানের বেশিরভাগই নিবেদন-সমর্পণের। এই নিবেদন ও সমর্পণ আবার দুই ধরনের। প্রথমত, পরমাত্মার কাছে আত্মার নিবেদন-সমর্পণ, দ্বিতীয়ত প্রেমিকের কাছে প্রেমিকার। একইভাবে পরমাত্মার অপেক্ষায় আত্মার অপেক্ষা; পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলন-বিচ্ছেদ-বিরহও। এদিক থেকে আরও একটি সত্য বের হয়ে আসে, পরমাত্মার সঙ্গে যেখানে আত্মার সম্পর্ক, সেখানেই আবার প্রেমিকের সঙ্গে প্রেমিকার সম্বন্ধ।  মানুষের ভেতরই আত্মা-পরমাত্মা—উভয়েরই বাস। এই বিবেচনায় বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের নারীবিষয়ক গানগুলোয় এই সত্য ষোলো আনাই উপস্থিত। 

শাহ আব্দুল করিমের নারীবিষয়ক গানে মূলত চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। 

  • ১। বিচ্ছেদ-বিরহ
  • ২। নিবেদন
  • ৩। অপেক্ষা
  • ৪। আধ্যাত্মচেতনা

তাঁর গানের সর্বাধিক অংশ জুড়ে রয়েছে বিচ্ছেদ-বিরহ প্রসঙ্গ। যেখানে বন্ধুত্ব শুরু, সেখানেই বিচ্ছেদ-বিরহেরও সূচনা। যেন মিলন-বিরহ রেল লাইনের মতোই সমান্তরাল গতিতে এগিয়েছে। ফলে তার গানে যেভাবে, যে-পথে মিলন প্রসঙ্গ এসেছে, সে-পথেই এসেছে বিরহও। এই ধারার গানগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, ‘কেন পিরিত বাড়াইলা রে বন্ধু ছেড়ে যাইবা যদি’, ‘কেমনে ভুলিব আমি, বাঁচি না তারে ছাড়া / আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভোমরা’, ‘আর জ্বালা সয়না গো সরলা’, ‘আমি কূলহারা কলংকিনী’, ‘আসি বলে গেল বন্ধু আইলো না গো / আসি বলে গেলো বন্ধু আইলো না / যাওয়ার কালে প্রাণ বন্ধে / নয়ন তুলে চাইলো না’, ‘হাত বান্ধিবি, পাও বান্ধিবি / মন বান্ধিবি কেমনে’, ‘আমি এই মিনতি করি রে এই মিনতি করি রে / সোনা বন্ধু ভুইলো না আমার’, ‘প্রাণে সহেনা দারুণ জ্বালা /  প্রেম-ফুলের গন্ধে ঠেকিয়াছি ফান্দে’, ‘ভাবিলে কী হবে গো / যা হইবার তা হইয়া গেছে’, ‘বন্ধুরে কই পাবো সখি গো / সখি আমারে বলো না/ আমার বন্ধু বিনে পাগল মনে বুঝাইলে বুঝে না’। মানব-মানবীর প্রেম হিসেবে দেখলে এসব গানে নারী হৃদয়ের আকুতি প্রকাশিত হয়েছে।

‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’ গানেও রাধা-কৃষ্ণের প্রতীকের আড়ালে একদিকে নারীর কামনা-বাসনা ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে পরামাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনাকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে।

দীর্ঘ অদর্শন কিংবা বিচ্ছেদ কিংবা বিরহে নারীহৃদয়ে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তারই চিত্র এসব গানে ফুটে উঠেছে। প্রেমিক-পুরুষ যখন নারীকে কামনা করে, তখন যতটা ভালোবাসার ডালি ঢেলে দেয়, তারও বেশি অভিনয় করে। এই অভিনয় কখনো কখনো প্রতারণার উদ্দেশ্যেও হয়। তখন অতিভক্তি ও অতিপ্রেমে নারীকে ব্যাকুল করে তোলে।

আর নারী যতই শক্ত মনের হোক, একবার তার হৃদয়ের পারদ গলতে শুরু করলে তখন আর তাকে স্থির রাখা যায় না। ওই মোক্ষম সময়ে প্রেমিকপুরুষ তার প্রেমের বড়শিতে কাঙ্ক্ষিত মাছ শিকার করে। সেই মাছের সঙ্গে কিছুদিন অভিনয় করার পর পুরুষটির স্বার্থসিদ্ধি হলে নারীটিকে ফেলে উধাও হয়ে যায়। হয়তো বা অন্য মাছশিকারে নতুন করে ছলনার বড়শি ফেলে সে। এই সময়ের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে, ‘কেন পিরিতি বাড়াইলা রে বন্ধু, ছেড়ে যাইবা যদি’ গানে।

আবার ‘কেমনে ভুলিব আমি’ গানটিতে বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আরও ভয়াবহ রূপে ফুটে উঠেছে। বিশেষত ‘না আসিলে কালো ভ্রমর/ কে হবে যৌবনের দোসর/ সে বিনে মোর শূন্য বাসর/ আমি জিয়ন্তে মরা’এই চরণগুলোয় নারীর মনোদৈহিক কামনার এক  চিরায়ত রূপ আঁকা হয়েছে। এছাড়া উল্লিখিত গানগুলোর প্রথম চরণেই বোঝা যায়, শাহ আব্দুল করিম নারীজীবনের নিগূঢ় বেদনাকে সহজেই আত্মস্থ করতে পেরেছেন। তিনি নারীর কামনাকে কেবল বাউলের দৃষ্টিতে দেখেননি, দেখেছেন সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতেও। ফলে অতি সাধারণ গৃহবধূর চিরায়ত সুখ-দুঃখ এসব গানে তিনি সহজেই বর্ণনা করতে পেরেছেন।

শাহ আব্দুল করিমের নারীবিষয়ক গানের দ্বিতীয় মুখ্য বিষয় হলো নিবেদন। প্রেমিক পুরুষের কাছে নারী নিজেকে যখন নিবেদন করে, তখন সর্বস্ব উজাড় করেই দেয়। নারী নিবেদনে কখনোই কার্পণ্য করে না। নারীর চিরায়ত রূপ, সে লজ্জাবতী। কিন্তু যখন সে প্রেমিকের কাছে নিজেকে সপে দেয়, তখন তথাকথিত লজ্জা আর সেই পুরুষের কাছে তার থাকে না। বরং নিজেকে সমর্পণের জন্য নারী ব্যাকুল হয়ে ওঠে।  নারীজীবনের এমন চিত্র আঁকা হয়েছে, ‘প্রাণনাথ ছাড়িয়া যাইও না বন্ধুরে’ গানে। আবার অপেক্ষায় নারীর জুড়ি মেলা ভার। মনের মানুষের জন্য সে যুগ যুগ ধরে অপেক্ষা করতে জানে, পারেও। যে নারী প্রেমে একনিষ্ঠ সে তার সাধনার পুরুষের জন্য অনন্তকাল ধরে অপেক্ষায় থাকে। আবহমানকালের এই-ই চিত্র, শাহ আব্দুল করিমও সেই ছবি তুলে ধরেছেন তার গানে। নারীর এই অপেক্ষার বর্ণনা রয়েছে ‘প্রাণে সহেনা দারুণ জ্বালা / প্রেম-ফুলের গন্ধে ঠেকিয়াছি ফান্দে/ গলেতে পরেছি প্রেম-মালা, মরণ ভালা / প্রাণে সহেনা দারুণ জ্বালা’, ‘বন্ধুরে কই পাবো সখি গো /সখি আমারে বলো না/ আমার বন্ধু বিনে পাগল মনে বুঝাইলে বুঝে না’ শীর্ষক গানগুলোয়। অপেক্ষার চিত্র সবচেয়ে বেশি অঙ্কিত হয়েছে, ‘তোমরা কুঞ্জ সাজাও গো/ আজ আমার প্রাণনাথ আসিতে পারে’ গানে।  নারী যে তার মনের মানুষের জন্য নিজেকে নানাভাবে সাজিয়ে প্রস্তুতি নেয়, তার বর্ণনা আছে। সেই প্রস্তুতি ও অপেক্ষার মাহাত্ম্য সহজেই বোঝার নয়। কিন্তু যিনি সমাজের নিয়ম-কানুনের বেড়াজাল জানেন, বুঝতে পারেন নারীহৃদয়ের আকুতি, তার পক্ষে অপেক্ষমাণ প্রেয়সীর ভাষা বোঝা কঠিন নয়। শাহ আব্দুল করিম সেই অন্তর্যামী মরমি কবিদের অন্যতম, যারা দেবতার মতোই মানুষের মন পড়তে পারেন। মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রকৃত স্থল কোথায়, সেই চিরবাঞ্ছিত কামনালোকও তিনি চেনেন। 

 শাহ আব্দুল করিমের নারীবিষয়ক গানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো  আধ্যাত্মচেতনা। এক্ষেত্রে মরমি সাধকের পক্ষে যা পরমাত্মার সঙ্গে আত্মার মিলনের সাধনা, তাই লোককবি ও আধুনিক কবির জন্য মানবপ্রেমের স্বরূপ। অর্থাৎ মরমি সাধকেরা পরমাত্মার সঙ্গলাভের যে তৃষ্ণা নিয়ে অপেক্ষা করেন, প্রেমিক-প্রেমিকা সেই তৃষ্ণা নিয়ে মনের মানুষকে পাওয়ার বাসনা প্রকাশ করে। এখানে আধ্যাত্মচেতনার সঙ্গে প্রচলিত প্রেমের বিরোধ নেই, বরং মিল বেশি। প্রচলিত প্রেম যেমন মনের মানুষকে পাওয়ার কথা বলে, তেমনি মরমি সাধকেরাও পরমাত্মার সঙ্গলাভের সাধনা করেন। শাহ আব্দুল করিম, এই বাসনাকে দ্বিকৌণিক দিক থেকে প্রয়োগ করেছেন। বিশেষত  ‘দেখা দেওনা কাছে নেওনা আর কতো থাকি দূরে’ গানের ভেতর দিয়ে উল্লিখিত বক্তব্যের প্রমাণ মিলবে। এই গানের এই দুটি চরণ পাঠ করে দেখা যাক, ‘মায়ার জালে বন্দি হইয়া আর কত দিন থাকিব/ মনে ভাবি সব ছাড়িয়া তোমাকে খুঁজে নেবো।’ অর্থাৎ নানা জনের নানা ছলনায় প্রেমপিয়াসী মন ভুলে গেছে কাঙ্ক্ষিতজনকে। হঠাৎ মনে পড়ায় সব ছেড়ে সেই বাঞ্ছিতজনকে ফিরে পেতে চায় সে।

অবশ্যই এই গান কেবল নারী কণ্ঠের জন্য নয়, বরং নারী-পুরুষ নির্বিশেষে নিখিল মরমিসাধকের জন্য। সেই সাধক, সাধনবলে এতটাই শক্তিমত্তা অর্জন করে যে, প্রেমিক পুরুষ কিংবা পরমাত্মার কাছে নিজেকে সমর্পণ করে না, বরং পরমাত্মা কিংবা প্রেমিককে বলে তার অধীন হতে। বলে, ‘ভক্তের অধীন হও চিরদিন থাকো ভক্তের অন্তরে’।  অর্থাৎ শাহ আব্দুল করিম আপেক্ষিক তত্ত্বেরই এক মহান সাধকমনের পরিচয় দিয়েছেন। তার  এই তত্ত্বের মূল কথা হলো—ভক্তকূল বা পূজারিই যদি না থাকে তো মুর্শিদ কিংবা দেব-দেবীর মূল্য কিসে?  প্রেমিক থাকলেই প্রেমিকা থাকবে, নারী থাকলে তার পুরুষও থাকবে। একের অনুপস্থিতিতে অন্যের অস্তিত্বও মিথ্যা। আবার ‘আমি কূলহারা কলঙ্কিনী’ গানেও রাধা-কৃষ্ণের প্রতীকের আড়ালে একদিকে নারীর কামনা-বাসনা ফুটে উঠেছে, অন্যদিকে পরামাত্মার সঙ্গে জীবাত্মার মিলনাকাঙ্ক্ষা প্রকাশিত হয়েছে। এভাবে শাহ আব্দুল করিম নারীর স্বভাব-বৈশিষ্ট্য-চারিত্র্য-হৃদয়াকুতিকে গানের পঙ্‌ক্তিবদ্ধ করেছেন।  

আজ ১২ সেপ্টেম্বর, আজ এই বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের প্রয়াণদিবস। ২০০৯ সালের আজকের এই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এই মহান মরমি সাধনের প্রয়াণ দিবসে তার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তিনি কেবল গানই রচনা করেননি, একইসঙ্গে সুরও করেছেন। আবার এসব গানে কণ্ঠ দিয়েছেন, করেছেন সংগীতের শিক্ষকতাও। শাহ আব্দুল করিম গানের অনুপ্রেরণা পেয়েছেন ফকির লালন শাহ, পুঞ্জু শাহ ও দুদ্দু শাহের দর্শন থেকে। তিনি বাউলগানের দীক্ষা দিয়েছেন সাধক রশীদ উদ্দীন, শাহ ইব্রাহীম মাস্তান বকশের কাছ থেকে। তিনি শরিয়তি, মারফতি, দেহতত্ত্ব, গণসংগীত, বাউল গান ছাড়াও গানের অন্যান্য শাখায় চর্চাও করেছেন। সবচেয়ে বিস্ময়ের বিষয় হলো, তিনি মরমি সাধক হয়েও কৃষিকাজকে মনেপ্রাণে লালন করেছেন। পেশায় মূলত ছিলেন কৃষক।

তার গানে এক ধরনের নির্মোহ-নিরাসক্তি আছে—সেই নিরাসক্তি এতটাই দৃঢ় যে, তাকে সেই দার্ঢ্য থেকে কেউ টলাতে পারেনি কোনো কোনো শক্তি-প্রলোভন। নারী-পুরুষের সম্পর্কের যে মর্মার্থ তার গানে প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তিনি কোনো পক্ষপাত দেখাননি। গানের ভেতর দিয়ে মনের মানুষের কাছে হৃদয়ের কথা যেমন বলেছেন, তেমনি পরমাত্মার কাছে আত্মার নিবেদনও প্রকাশ করেছেন। বিশেষত নারী চরিত্রের জবানিতে উচ্চারিত গানগুলোয় এই প্রবণতা বেশি।

মূল আলোচ্য বিষয়ের সঙ্গ আপাতসঙ্গতিপূর্ণ নয়, তবু একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন মনে করি। কালিকা প্রসাদ এক সংগীতানুষ্ঠানে জানিয়েছেন—শাহ আব্দুল করিম মনে করতেন পৃথিবীটা একদিন বাউলের হবে। কালিকা প্রসাদের সাক্ষ্য বলছে—শাহ আব্দুল করিম কেবল মরমি সাধকই ছিলেন না, একইসঙ্গে ছিলেন উদার মানবতাবাদী। ছিলেন সমাজসচেতন, রক্তমাংসের প্রেমিক মানুষ। তিনি যেমন বাউল ছিলেন, তেমনি ছিলেন শতভাগ অসাম্প্রদায়িকও।

সংগীতে অসামান্য অবদানের জন্য পেয়েছেন একুশে পদক (২০০১), কথা সাহিত্যিক আবদুর রউফ চৌধুরি পদক (২০০০), রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার (২০০০), লেবাক অ্যাওয়ার্ড (২০০৩), মেরিল-প্রথম আলো পুরস্কার আজীবন সম্মাননা (২০০৪), সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ডস আজীবন সম্মাননা (২০০৫), বাংলাদেশ জাতিসংঘ সমিতি সম্মাননা (২০০৬), খান বাহাদুর এহিয়া পদক (২০০৮), বাংলাদেশ শিল্পকলা অ্যাকাডেমি সম্মাননা (২০০৮), হাতিল অ্যাওয়ার্ড (২০০৯), এনসিসি ব্যাংক এনএ সম্মাননা (২০০৯)।

আজ ১২ সেপ্টেম্বর, আজ এই বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের প্রয়াণদিবস। ২০০৯ সালের আজকের এই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন। এই মহান মরমি সাধনের প্রয়াণ দিবসে তার স্মৃতির প্রতি জানাই শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ