Skip to content

২৫শে অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দ | শুক্রবার | ৯ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পুরুষতন্ত্র কেন ‘নারীর বিয়ের বয়স’ ঠিক করবে?

সমাজে এখনো নারীকে নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া হয় না। শিক্ষক-আইনজীবী-সমাজকর্মীরা বলছেন, নারীর পেশা থেকে নিয়ে কোনো কিছুই নির্বাচনের ক্ষেত্রে তার স্বাধীনতা নেই। পড়াশোনা থেকে শুরু করে চাকরি পর্যন্ত কখনো বাবা কখনো ভাই, কখনো স্বামীর ইচ্ছার দাসী হিসেবেই থাকতে হয় নারীকে। আর বিয়ে? সে তো আরও কঠিন ব্যাপার। নারীকে বিয়ে করতে হবে, কিশোরী বয়স পার হওয়া আগেই। আর সে বিয়ে হবে সম্পূর্ণ বাবা-ভাই বা পরিবারের অন্য কোনো পুরুষ সদস্য ও সমাজের পুরুষ কর্তাদের ইচ্ছা অনুসারে। নারী পড়াশোনা করে নিজে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তারপর বিয়ে করবে, এমন ইচ্ছার কথা প্রকাশ করলেই তার ওপর বিপদ জেঁকে বসবে। সমাজ তাকে দেখবে সন্দেহের চোখে। শিক্ষক-আইনজীবী-সমাজকর্মীরা প্রশ্ন তুলছেন, আদৌ সমাজের এই পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের পরিবর্তন হবে?

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক শাহনাজ পারভীন রিমি বলেন, ‘বিয়ে বিষয়টিকে আমি স্বাচ্ছন্দ্য এবং অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করতে বেশি আগ্রহী। নারী হোক বা পুরুষ, মানুষ হিসেবে তার অধিকার রয়েছে স্বাধীন নির্বাচনের। আমি এমন অনেক নারীকে, জানি যারা বিয়ে, পরিবার গঠন অর্থাৎ সংসারটা খুব ভালোবেসে করছেন। সঙ্গীর পরিচয়ে পরিচিত হতে তাদের তেমন কোনো আপত্তি নেই। আবার, এমন অনেক নারী আছেন, যারা শুরু থেকেই বিয়ে নামক সামাজিক আনুষ্ঠানিকতাকে জীবনে মুখ্য লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেননি। বরং তাদের কাছে একটা স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করে স্বপ্নের সমান বড় হওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা ছিল বেশি প্রবল। এর অর্থ এই নয় যে, তারা বিয়ে বিষয়টি জীবন থেকে একেবারেই বিসর্জন দিয়ে দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে, বিয়ের থেকে তাদের কাছে পড়ালেখা, প্রতিষ্ঠিত হওয়া অগ্রাধিকার পেয়েছে।’

এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘নারীর এই প্রথম অবস্থানটি আমাদের পরিবার, সমাজ এবং বেশিরভাগ নারীরা যেভাবে সাদরে গ্রহণ করে থাকে, নারীর দ্বিতীয় অবস্থানটি মেনে নিতে বেশ আপত্তি দেখা যায়। এর মূল কারণ হিসেবে বার বার যে শব্দটি উঠে আসে, সেটি হলো নারীর বয়স। কন্যা থেকে পরিণত নারী; জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অত্যন্ত সচেতনভাবে একটা নির্দিষ্ট সীমারেখা টেনে দেয় আমাদের পরিবার, আমাদের সমাজ। যেখানে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কেন্দ্রস্থল, নিম্নশ্রেণি থেকে উচ্চশ্রেণির মানুষের মস্তিষ্কে জগদ্দল পাথরের মতো এখনো প্রকট মাতৃগর্ভের ভ্রূণের লিঙ্গ নির্ধারণ প্রক্রিয়া, সেখানে নারীর পছন্দ, স্বাধীনতা বা অধিকারের মতো বিষয়গুলো কতটা প্রাধান্য পাবে, তা বেশ প্রশ্নসাপেক্ষ। সময় এগিয়েছে, পৃথিবীটা পরিবর্তিত হচ্ছে দ্রুত গতিতে। কিন্তু নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পট পরিবর্তন আলোর মুখ দেখে না।’

শাহনাজ পারভীন রিমি

শাহনাজ পারভীন রিমি বলেন, ‘একটা মেয়ে যদি বিয়েটাকে স্বাচ্ছন্দ্যের সহিত মেনে নেয়, এবং সমাজ সেটাকে সাধুবাদ জানায়। কিন্তু একটা মেয়ে যখন সাবলম্বী হয়ে নিজের পরিবার ও দেশের পাশে দাঁড়াতে চায়, তখন সমাজ সেটাকে স্বাগত জানাতে আগ্রহী নয়। কারণ, নারীর উন্নয়ন বিষয়ক চিন্তা কেবল উৎপাদনশীলতার মধ্যেই সীমিত রাখতে তৎপর গোটা মনুষ্যজাতি। নারী কেবল সন্তান উৎপাদনের একটা মাধ্যম হিসেবেই গণ্য। তাই, নারীর প্রগতিশীলতায় বয়স একটা বড় বাধা।’ তিনি বলেন, ‘জীবনের প্রতিটা পর্যায়ে নারীকে পদে পদে মনে করিয়ে দেওয়া হয় তার বয়সের সংখ্যা। কিন্তু একটু ভিন্নভাবেও তো ভাবা যেতে পারে! জীবন যার, তাকেই ঠিক করতে দেওয়া হোক, সে কোনটা অগ্রাধিকার দেবে! বোঝা নয় বরং নারীরা এখন চায় পুরুষের যথার্থই সহযাত্রী হতে, শিক্ষিত মা হিসেবে আলোকিত হতে এবং আলোকিত করতে। নারীর এই যাত্রায় তাই সহযোগিতা কাম্য, সান্ত্বনা বা সহমর্মিতা নয়।’

ন্যাশনাল হেলথকেয়ার নেটওয়ার্ক (এনএইচএন)-এর যুগ্ম-পরিচালক (প্রশাসন) সায়রা মুন্নী বলেন, ‘‘বেশি দূরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, এই আমাদের ঘরেরই কথা। বড় ভাইয়ের বিয়ের জন্য মেয়ে খোঁজা হচ্ছিল। ৩/৪ জন মেয়ে পাওয়া গেলো সবাই মাস্টার্স পান, কেউ কেউ চাকরিজীবী। আত্মীয়-স্বজন সব হা-হা করে উঠলেন,‘না-না। এই মেয়েদের তো বয়স অনেক বেশি, এদের তো মানানো যাবে না।’ এভাবেই বিয়েগুলো এক-এক করে ভেঙে যায়। অর্থাৎ আমাদের সমাজে বেশি বয়সে পুরুষদের বিয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা পোহাতে হয় না, যতটা হয় মেয়েদের ক্ষেত্রে।’’

সায়রা মুন্নী

এর পেছনের কিছু কারণ ব্যাখ্যা করে সায়রা মুন্নী বলেন, ‘‘প্রথমত, বেশি বয়সে বিয়ে হলে সন্তান না হওয়ার একটা ভয় থাকে। দ্বিতীয়ত, আমাদের সমাজ এখনো অনেক পিছিয়ে আছে। কারণ পুরুষগণ মনে করেন কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে করলে তাদের মানানো যায়। কিন্তু বেশি বয়সী মেয়েদের বিয়ে করলে তারা কথায় কথায় কেবল তর্ক করে, যুক্তি দেখায়। ফলে সংসারে এডজাস্টমেন্টে সমস্যা হয়। তৃতীয়ত, মেয়েদের বয়স বেশি হলে এবং বিয়ে না হলে বাবা-মায়ের কাছে বোঝা বলে মনে করা হয়। চতুর্থত, সম্পর্ক ও বিয়ের ক্ষেত্রে বেশি বয়সী মেয়েদের সামাজিকভাবে গ্রহণযোগতা কম থাকে। পঞ্চমত, একটা প্রবাদ আছে, যা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে তা হলো, ‘বাঙালি মেয়েরা কুড়িতেই বুড়ি’। এই প্রবাদটিও অনেকাংশে দায়ী। সমাজের এমন দৃষ্টিভঙ্গি পুরোনো হলেও এখনো তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি।’’

কথাসাহিত্যিক ও অনুবাদক আফসানা বেগম বলেন, ‘‘সমাজে প্রচলিত ধারণা আছে যে, ছেলেরা যেকোনো বয়সে বিয়ে করতে পারে আর মেয়েদের ক্ষেত্রে আছে ‘বিয়ের বয়স।’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটির অভিজ্ঞতা আর কাজের নিশ্চয়তা যত বাড়তে থাকে, বিয়ের পাত্র হিসেবে তার মূল্যও বাড়ে। কিন্তু মেয়েদের বেলায় অনেক ক্ষেত্রে এমনকি সে পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোরও সুযোগ পায় না। তার আগেই ‘বিয়ের বয়স গেলো গেলো’ বলে পরিবার তাকে সংসারের হাল ধরতে বাধ্য করে।’’ তিনি বলেন, ‘‘এই সব ধারণা সমাজের সাজানো, বিশেষত পুরুষতান্ত্রিক সুবিধা ভোগের জন্য। বয়স বাড়লে মেয়েটি পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়ালে তার একটি ‘কণ্ঠ’ তৈরি হয়, সে পরিবারে অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলে, নিজের কী চায়, তা স্পষ্ট জানায়। তাই সে রকম যোগ্যতার একজন নারীকে পরিবার ‘বউ’ হিসেবে কল্পনা করতে আশঙ্কা বোধ করে। মূলত অতি অল্প বয়সে বিয়ের পর বউটির ওপর প্রভাব বিস্তার করা সহজ হয়। অন্যদিকে, সমাজের কুটিল চিন্তকেরা মনে করেন, প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে বিবাহের সম্পর্কে নেই মানেই হলো সে কোনো না কোনো অনৈতিক সম্পর্কে জড়িত। এরকম কল্পনা থেকেও প্রাপ্তবয়স্ক অবিবাহিত মেয়েকে সমাজ কোণঠাসা করতে পারে।’’

আফসানা বেগম

আফসানা বেগম আরও বলেন, ‘সমাজে একটি মেয়ে যতই বিদূষী ও কর্মক্ষেত্রে সফল হোক না কেন, পুরুষ সঙ্গী ছাড়া জীবন যাপন করলে সমাজ তাকে সন্দেহের চোখে দেখে। অন্যদিকে, একটি মেয়ে তথাকথিত বিয়ের বয়স পার হওয়ার পরেও পরিবার বা একজন ‘স্বামী’-র সাহায্য ছাড়াই নিজ যোগ্যতায় আয়-রোজগার থেকে শুরু করে নিজের তাবৎ শখ মেটাতে পারে। এটা দেখলে সমাজের পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারণায় আঘাত লাগে। সমাজ নারীকে বরাবর সংসারে আবদ্ধ ও স্বামী-সন্তানের প্রতি উৎসর্গীকৃত দেখতে চায়।’’ তিনি বলেন, ‘‘সমাজের বেশিরভাগ মানুষের কাছে একজন ‘যোগ্য কর্মী’র চেয়ে একজন ‘পতিব্রতা স্ত্রী’ বা ‘মহৎ মা’ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই একাকী একজন নারী সমাজের চাওয়া-পাওয়ার তোয়াক্কা না-করে মাথা উঁচু করে বেশিদিন চললে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির ওপরে চাপ পড়ে। এই চাপ কমানোর একমাত্র উপায় হয়ে ওঠে, ‘বিয়ের বয়স’ হলেই মেয়েটিকে বিয়ে করতে বাধ্য করা। নারীর নিজ পরিবার থেকে শুরু করে আস্ত সমাজ এই ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকে।’’

চাঁপাইনবাবগঞ্জের আইনজীবী রেহানা বীথি বলেন, ‘বছর ছ’য়ের একটি মেয়ে শিশু গ্রামের পথে ছোটাছুটি করে খেলাধুলায় যখন ভীষণ ব্যস্ত, ঠিক তখনই শিশুটির শ্বশুর ওই পথ দিয়ে জমিতে যাচ্ছিল। শিশুটি জানে, মানে তাকে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে, শ্বশুর-শাশুড়িকে দেখলে মাথায় কাপড় দিতে হয়। কিন্তু শিশুটির পরনে কাপড় বলতে শুধু নিম্নাঙ্গে একখানা গামছা ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কী আর করা, ওটাকেই খুলে মাথা ঢেকে মান-সম্মান রক্ষা করেছিল বেচারি!’

রেহেনা বীথি

রেহানা বীথি বলেন, ‘মুখে মুখে প্রচলিত এই গল্পটির ঘটনা আজ থেকে প্রায় ৬০-৭০ বছর আগের। কিন্তু তৎ-পরবর্তীকালেও কি মেয়েদের বিয়ের ব্যাপারে আমাদের ধারণা খুব বেশি পাল্টেছে? এখন আমরা কন্যা সন্তানকে লেখাপড়া করতে, চাকরি করতে হয়তো বাধা দিচ্ছি না, তবে বিয়ে বিষয়ে আমাদের অবস্থানের খুব একটা নড়চড় হয়নি। যত দ্রুত সম্ভব পাত্রস্থ করতে পারলেই আমাদের মুক্তি। এই মনোভাব থেকে আমাদের সমাজ আজও বেরিয়ে আসতে পারেনি। এখনো ১২-১৩ বছর কিংবা ১৬ থেকে ১৮ বছর বয়সী মেয়েকে আমরা অনায়াসেই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিচ্ছি। আর তা যে শুধু দরিদ্র পরিবারগুলোতেই হচ্ছে তা নয়, অনেক শিক্ষিত ও আর্থিকভাবে সচ্ছল পরিবারেও এমনটা ঘটছে। কারণ হিসেবে বয়স বেড়ে গেলে বিয়ে হবে না, যৌন হয়রানি থেকে রক্ষা, বাচ্চা নিতে সমস্যা, মেয়েদের বিপথে চলে যাওয়ার আশঙ্কাও সামনে আনা হচ্ছে। মেয়েদের শারীরিক, মানসিক সক্ষমতার কথা ভাবাই হচ্ছে না। আর্থিক সক্ষমতা কিংবা স্বাবলম্বী হতে হবে, এ চিন্তা তো দূর।’

এই আইনজীবী বলেন, ‘‘আজও আমরা ধরেই নেই, মেয়ে মানেই বিয়ে করে সংসারী হবে। মেয়েও যে একটা সংসারের হাল ধরতে পারে, ঘরে-বাইরে সমান তালে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। আমাদের সমাজ এখনো সেটা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে না। সে কারণেই ‘কুড়িতে বুড়ি’ – এই কনসেপ্টেই এখনো আটকে আছি আমরা। আটকে আছি ‘মেয়ে মানেই বোঝা’ এই মনোভাবেও। যেসব মেয়ে এই ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে সমাজের মুখোমুখি দাঁড়াচ্ছে, তাদের নিয়ে সমাজের ‘গেলো গেলো’ ভাব। ’’ তিনি আরও বলেন, ‘সমাজের এমন অনগ্রসর মনোভাবের যতদিন না পরিবর্তন হচ্ছে, ততদিন বাল্যবিয়ে কেন, মেয়েদের হেয় প্রতিপন্ন করাও দূর হবে না।’

ডাউনলোড করুন অনন্যা অ্যাপ