জাপানের বিস্ময়কর হাইওয়ে, নেই কোনো শব্দ!
হাইওয়ে বা বাংলায় মহাসড়ক। শব্দটি কল্পনা করতেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে বিশাল এক রাস্তা। আর তার ওপর দিয়ে সুপার স্পিডে চলমান গাড়ির দৃশ্য। আর এসব দৃশ্যের সঙ্গে উচ্চহারে গাড়ির আওয়াজ তো ফ্রিতে রয়েছেই। এমন দৃশ্যের সঙ্গে আমরা খুবই পরিচিত। তবে জাপানিদের হাইওয়ের চিত্র কিছুটা ভিন্নই বটে। আর হাইওয়ে নিয়ে রয়েছে মজাদার কাহিনিও।
জাপানের অধিকাংশ হাইওয়ে তৈরি হয় ১৯৫৬ সালে। হাইওয়ের যা বৈশিষ্ট্য তা মেনেই শুরু হলো এর যাত্রা। নেই ট্রাফিক সিগন্যাল, রাস্তার মধ্যে সাই সাই করে চলছে সব গাড়ি। গাড়ি তো চলছে, যাত্রীরাও গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে। তবে এদিকে ঘোর বিপাকে রাস্তার দুপাশের অধিবাসীরা। গাড়ির উচ্চ শব্দে চোখের ঘুম হারাম তাদের।
বাধ্য হয়ে সরকারের কাছে নালিশ দিলেন হাইওয়ের পাশের অধিবাসীরা। তাদের আবদার, ‘আওয়াজের যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না, রাস্তা সরান’। কিন্তু রাস্তা সরানো কি আর মুখের কথা? তবে উপায়? বাধ্য হয়ে তড়িঘড়ি করে সরকার বুদ্ধিজীবীদের ডাকলো এবং পরামর্শ চাইলো। বুদ্ধিজীবীরা সরকারকে বুদ্ধি দিলেন।
প্রথমেই শিশু থেকে বৃদ্ধ বিভিন্ন বয়সের ২০০ জন অধিবাসীদের ওপর সমীক্ষা চালানো হলো। শব্দহীন রুমের ভেতর দিনে রাতে বিভিন্ন সময় তাদের ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হলো। তারপর ৩০ ডেসিবল থেকে ১০০ ডেসিবল পর্যন্ত কৃত্রিম গাড়ির শব্দ বাজিয়ে দেখা হলো এবং কার কত ডেসিবেলে ঘুম ভাঙলো তা রেকর্ড করা হলো।
এরপর সরকার এ ফলের ভিত্তিতে নতুন আওয়াজ আইন জারি করলো। সে আইন অনুসারে কোনো বাড়িতে যদি দুপুরে ৭৫ ডেসিবল ও রাতে ৬৫ ডেসিবেলের বেশি আওয়াজ পাওয়া যায়, তাহলে তারা জরিমানার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এর নাম ঘুম ভাঙা জরিমানা। সরকারের নির্দেশে আওয়াজ মাপা শুরু হলো।
অন্যদিকে নাগরিকদের সুবিধার্থে দেওয়া হলো একটি ফোন নম্বর। বলা হলো, যদি গাড়ির শব্দের কারণে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে, তাহলে যেন এই নম্বরে ফোন করা হয়। এখানেও রয়েছে একটি মজার ব্যাপার। ফোন নম্বরের শুরুতেই ০১২০ থাকা মানেই এই ফোন নম্বরটি একদম ফ্রি। যিনি কল করবেন তার কোনো টাকা কাটা যাবে না, বরং যাকে ফোন করা হবে তিনিই টাকা দেবেন।
এরপর শুরু হলো সেই নম্বরে ফোনকল আসা। এদিকে জরিমানা দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিলো জাপানের হাইওয়ে অপারেটর নেক্সকো কোম্পানি। ৮ হাজার ৫০০ কিলোমিটার রাস্তার মালিক তারা। জরিমানার টাকা গুনতে রীতিমতো মাথায় হাত তাদের। এবার তারা আবার বুদ্ধিজীবীদের ডাকলো। শব্দ ও মানুষের কষ্ট দুটোই কমানোর জন্য প্রযুক্তিগত বুদ্ধি চাইলো তারা।
নানা বিশ্লেষণের পর দুটো প্রযুক্তি কাজে লাগানো হলো। তার মধ্যে প্রথমটি হলো, যেহেতু ইঞ্জিনের সমস্যা না থাকলে আওয়াজ তৈরি হয় টায়ার আর রাস্তার ঘর্ষণ থেকে। তাই নতুন উপাদান দিয়ে রাস্তার ওপর প্রলেপ বসানো হলো। গাড়ি কোম্পানিগুলোকেও ডেকে বলা হলো কম আওয়াজের টাওয়ার আর গাড়ির শব্দ কমানোর জন্য। দ্বিতীয় সমাধানটি ছিল, রাস্তার ২ ধারে বসানো হলো শব্দ প্রতিরোধী বেড়া। এটা অত্যন্ত ব্যয়বহুল হলেও ঘুম ভাঙার জন্য যে জরিমানা গুনতে হতো তার চেয়ে অনেক কম।
এত কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে হাইওয়ের পাশের অধিবাসীদের শান্তি মিললো। এবার আর আওয়াজে তাদের ঘুম ভাঙার আশঙ্কা নেই বললেই চলে। সবাই যখন শান্তির নিশ্বাস ফেলছিল, এবার বোধহয় সব ঝামেলা মিটেই গেলো, ঠিক তখনই শুরু হলো নতুন ঝামেলা।
আবারও এলো নালিশ। তবে এবার অধিবাসীদের থেকে নয় বরং যারা গাড়ি চালান, এবার নালিশ এলো তাদের পক্ষ থেকে। যদিও আমাদের দেশে রাস্তায় চলতে কোনো টোল দিতে হয় না, যদি না আপনি কোনো সেতু কিংবা ফেরী পার হন। তবে জাপানে কিন্তু প্রাইভেট যানবাহনের মালিককে প্রতি কিলোমিটার রাস্তা চলাচলের জন্য গুনতে হয় প্রায় ২৫ টাকার মতো৷ অর্থাৎ যদি ঢাকা থেকে আপনি চট্টগ্রামের দূরত্বে যেতে চান আপনাকে টোল দিতে হবে ৬ হাজর ২৫০ টাকা।
তাই এবার গাড়ির মালিকদের আক্ষেপ আমরা এত টাকা টোল দিয়ে হাইওয়েতে যাবো আর চারদিকের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখবো না? আবারও বিপাকে পড়লেন রাস্তার মালিকরা। এবার তাদের চিন্তা এমন কোনো ব্যবস্থা করা যেন দু’পক্ষই শান্তিতে থাকতে পারে। যেমন কথা তেমন কাজ। রাস্তার মালিকরা আবার বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি চাইলেন। আর নানা কসরত করে সমাধান বেরোলো সাউন্ড প্রুফ স্বচ্ছ দেয়াল।
সাউন্ড প্রুফ দেয়াল কাচের মতো কোনো পদার্থ দিয়ে তৈরি। যাতে সৌন্দর্যও দেখা যাবে শব্দ দূষণও ঠেকাবে। বর্তমানে জাপানের আবাসিক এরিয়াগুলোর হাইওয়েতে যে সাদা স্বচ্ছ একধরনের দেয়াল দেখা যায়, তাই হলো সাউন্ড প্রুফ দেয়াল। প্রযুক্তির জয়টা আসলে এখানেই। আর বরাবরই জাপান প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে করেছে নতুন নতুন উদ্ভাবন।
অন্যদিকে আমাদের ঢাকা শহরের কথা যদি বলি এখানে গড়ে শব্দ দূষণের পরিমাণ ৯০ ডেসিবলের কাছাকাছি। এর বেশিটাই আসে গাড়ির হর্ন থেকে। যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর তো বটেই। কিন্তু জাপানের মতো প্রযুক্তির আশীর্বাদ কাজে লাগিয়ে কোনো উদ্ভাবন করতে এখনো আমরা অনেকটা অপারগ। তবে শুধু বাংলাদেশই নয় বিশ্বের প্রত্যেকটি দেশেরই উচিত শব্দ দূষণ রোধ করার এমন বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করা।