বৈবাহিক ধর্ষণের শেষ কোথায়
পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীদের সর্বদাই ঘরকুনো করে গড়ে তোলা হয়। ঘরের বাইরেই শুধু নারী পরাধীন, নিরাপত্তাহীন নয়। বরং ঘরেও তারা অনিরাপদ, অসহায় জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু বরাবরই নারীরা কিছু বিষয় নিয়ে মুখ খুলতে নারাজ। সাংসারিক দ্বন্দ্ব-সংঘাত যেমন মুখ বুজে সহ্য করে, তেমনই শারীরিক বা দৈহিক নির্যাতন নিয়েও কথায় বলতে চায় না।
একদিকে লোকলজ্জা, অন্যদিকে স্বামীর মান-মর্যাদা; সর্বোপরি মাথাগোঁজার ঠাঁইটুকু হারাতে চায় না নারীরা। ফলে বহু নারী দিনের পর দিন স্বামীর পাশবিক অত্যাচার নীরবে হজম করে। এক্ষেত্রে বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কথা বলাই মানা। অনেক সুশীল, প্রাজ্ঞ মানুষেরও বিষয়টি শুনে, উপলব্ধি করে বা পড়ে গা শিটিয়ে উঠতে পারে। এই বিষয় নিয়েও ভাবা যেতে পারে বা শিকার হওয়া নারী প্রতিকার চাইতে আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন, এ যেন মহাশূন্যে গমনের মতোই দুঃসাধ্য ব্যাপার।
সামাজের পোশাকি বা মেকি ভদ্রতার আড়ালে নিজের ইচ্ছেশক্তিকেই প্রাধান্য দেয় অনেক পুরুষ। ফলে পারস্পরিক সম্মতির কথা পুরুষের মাথায় কাজই করে না। কারণ সামাজিকভাবে পুরুষতন্ত্র মনেই করে, বিয়ে হওয়া মানেই বউ তার নিজের সম্পত্তি। তাকে জমির মতো ভোগ দখল করা যায়। পুরুষের যৌনফ্যান্টাসির শিকার হয় তাই নারীরা। সেক্ষেত্রে নারীও বিভিন্নভাবে মেনে এবং মানিয়ে নিতে চেষ্টা করে।
বৈবাহিক ধর্ষণ তখনই হয়, যখন কোনো দম্পতির একজন অন্যজনকে জোরপূর্বক দৈহিক মিলনে বাধ্য করে। আমাদের দেশে সামাজিক সংস্কার-কুসংস্কারের ফলে নারীরা নিজেদের স্বামীর সেবাদাসী ভেবে আসছে চিরকাল। আর নারী-পুরুষের অনেকের কাছে সামাজিক পারিবারিকভাবে বিয়ে করে যদি স্বামীর এতটুকু অধিকার না জন্মায় তবে কেন বিয়ে? বিষয়টি কী সত্যিই এমন! ম্যারিটাল রেপ তখনই হবে, যখন সঙ্গীর ওপর জোর খাটানো হবে। ইচ্ছের বিরুদ্ধেই নিজের পাশবিক লালসা চরিতার্থ করা হবে। স্ত্রীর শারীরিক, মানসিক অসুস্থতা সত্ত্বেও তাকে দৈহিক মিলনে বাধ্য করা অপরাধ। আর এর ফলে মনে শুধু বিষাদের জন্ম নেয়, আনন্দ নয়।
এখন একটা কথা স্বীকার করুন তো এই সিরিজ কি মন ছুঁয়ে যায়নি? কিন্তু কেন মন ছুঁইলো? কারণ বিষয়টি সমাজের ঘটে চলা ইস্যু।
স্বেচ্ছায়, সজ্ঞানে ও সম্মতিতে যদি যৌনসংসর্গ গড়ে তোলা না হয়, তবে তা অবশ্যই ম্যারিটাল রেপ। আর এটি পুরুষের পশুসুলভ আচরণ। যার শিকার বহু নারী।
কথা হলো নারীরা কেন মুখ বুজে সহ্য করে? এর পেছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে। সবচেয়ে যে বিষয়টা নারীদের দমিয়ে রাখে, তা হলো অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা। বহু নারী স্বামীর উপার্জিত অর্থেই নিজেকে সাজিয়ে তোলেন, জীবন পরিচালনা করেন। ফলে মাথার ওপর নিশ্চিত ছাদ ফেলে অনিশ্চয়তার পথে হাঁটতে চান না। আর জাতি হিসেবে আমরা পরিবর্তনকে সাদরে গ্রহণ করতে পারি না। ফলে মেনে নিয়ে এবং মানিয়ে নিয়েই জীবন অতিবাহিত করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠি।
আলোচনার সাক্ষ্য মানতে ভারতীয় একটি ওয়েব সিরিজের প্রসঙ্গ উপস্থাপন না করলেই নয়। ওয়েব সিরিজটির নাম সম্পূর্ণা। আলোচিত ও সাড়া জাগানো একটি সিরিজ। তবে সিরিজের আলোচনায় আসার আগে পরিপ্রেক্ষিতের দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। পরিসংখ্যান দেখলে বা লাইক কমেন্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এই সিরিজের বেশিরভাগ দর্শক নারী। নিচের কমেন্টস ও তার প্রমাণ। অধিকাংশ নারীই সিরিজটিকে সাদরে গ্রহণ করেছেন। সবার নানারকম মন্তব্যের ভারে কমেন্টস বক্স পরিপূর্ণ। এখন একটা কথা স্বীকার করুন তো এই সিরিজ কি মন ছুঁয়ে যায়নি? কিন্তু কেন মন ছুঁইলো? কারণ বিষয়টি সমাজের ঘটে চলা ইস্যু। অনেক নারীর বোবা কান্না একসঙ্গে মিশে গেছে। তাই তো এতটা ভিউ। তাহলে কী বোঝা যাচ্ছে না নারীরা সত্যিই এই ধরনের অ্যাবিউজের শিকার?
অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। সর্বোপরি বলবো নারীবান্ধব আইনব্যবস্থা গড়ে উঠুক। ম্যারিটাল রেপকে আমলে আনতে হবে। নারীরা যেন আইনি সহোযোগিতা পায়, সে ধরনের সুব্যবস্থা করা হোক আইন করে।
নারীর জন্য ছেলের বাড়ির পরিবার কোনোদিনই কোনো দায় নেয় না বা নিতে চায় না। তারা শুধু দোষারোপে ব্যস্ত। নিজ সন্তানের কতটা অপরাধ সে বিষয় নিয়ে কোনোই উচ্চবাচ্য নেই। এই সিরিজের নন্দিনীর শাশুড়ির মতোই যেন বেশিরভাগ শ্বশুরবাড়ির চিত্র। পরের সন্তানটাকে যখন ঘরে আনে, তখন নিজের কন্যাসম ভাবতে শেখান না কেউ। কিন্তু সেই কন্যার জন্য কোনটা মঙ্গল সেটাই ভুলেযান এ সব স্বার্থবাদী মানুষ। তবে ঘটনার একটু ব্যাখ্যা দিতেই হয়। নন্দিনীর স্বামী যিনি উচ্চশিক্ষিত, ভালো চাকরি করে। অভিজাত পরিবারের সন্তান বলা যায়। তবে মানসিকভাবে বিকারগ্রস্ত। কুরুচিপূর্ণ আচরণ। নিজের লালসা কামনায় নন্দিনীর সঙ্গে চলে বৈবাহিক ধর্ষণ।
সম্পূর্ণা ওই বাড়ির বড় বউ। তারও জীবনচিত্র এসেছে করুণভাবে। সবচেয়ে আশ্চর্য হতে হয় মেয়ের বাড়ির পরিবার দেখে! তারা কত নির্বিকার। নিজের সন্তান মরে যাক সমস্যা নাই তাদের ভালো করতে হবে। আর তার জন্য সব অত্যাচার সহ্য করতে হবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত একটি মুক্তির বার্তা দিয়ে সিরিজটি শেষ হলো। কিন্তু সিরিজটিতে মুক্তির বার্তা পেলেও আামদের সমাজের নারীদের কাছে কী বার্তা পৌঁছেছে?
নারীরা নিজের ইচ্ছেকে গলা টিপে হত্যা না করুক। অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক। সর্বোপরি বলবো নারীবান্ধব আইনব্যবস্থা গড়ে উঠুক। ম্যারিটাল রেপকে আমলে আনতে হবে। নারীরা যেন আইনি সহোযোগিতা পায়, সে ধরনের সুব্যবস্থা করা হোক আইন করে। এ ব্যাপারে নারীর সচেতন হওয়াও খুব জরুরি। নারীদের বুঝতে হবে, তারা যৌনদাসী নয় যে, বিয়ে হলেই তাকে স্বামীর অত্যাচার মুখ বুজে সয়তে হবে। অত্যাচার-নিপীড়ন সবসময়ই অপরাধ। তাই নারীকেই নীরব না থেকে প্রতিবাদী হতে হবে।