পরিবারে কবে গুরুত্ব পাবে নারীর অভিমত?
‘নারী’কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন, ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর / অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।’ কবিতায় এ ধরনের মূল্যায়ন-স্বীকৃতি ভুরি ভুরি থাকলেও বাস্তবে নৈব নৈব চ। বাস্তবে নারীকে এ ধরনের কৃতিত্বের অংশীদার বলে মেনে নেওয়া দূরে থাক, পরিবারে-সমাজে, এমনকি কর্মক্ষেত্রেও তার অভিমতের ন্যূনতম মূল্যায়ন করা হয় না।
কে না জানে, নারী-পুরুষের সম্মিলিত চেষ্টায়ই পরিবারের ভিত্তি গড়ে ওঠে। অথচ সেই পরিবার থেকেই শুরু হয় নারীর প্রতি সংহিস আচরণ। সেখানেই নারীর যোগ্য মূল্যায়ন করা হয় না। বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নারীরা পিতৃগৃহ ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গেই যেন বাবার সব বিষয় আশয় থেকেও বন্ধনচ্যুত হয়ে পড়ে। এটা আরও বোঝা যায়, যখন আসে সম্পত্তি বণ্টনের প্রশ্ন! এক্ষেত্রে নারীর অভিমতকেও কোনো রকম প্রধান্য দেওয়া হয় না। এমনকি সম্পত্তি বণ্টনের ব্যাপারে নারীর ক্ষেত্রে দেখা দেয় অসামঞ্জস্যতা। নারীকে পৈতৃক সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত রাখার চেষ্টা আবহমান কাল থেকে চলে আসছে।
পরিবার ও সমাজে বিশ্বাস করা হয়, নারীরা পরের ঘরে চলে যাবে, তাই তার পেছনে বেশি শ্রম, টাকা ঢেলে লাভ নেই! এমনই মানসিকতা সর্বত্র! যুগের পরিবর্তন এলেও মানসিকতার পরিবর্তন হয়নি।
এরপর আছে পারিবারিক অনুষ্ঠান। এসব অনুষ্ঠানে নারী-পুরুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ থাকলেও সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য বজায় থাকে। নারীরাও অনেক সময় পুরুষের কাঁধে দায়িত্ব দিয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। কিন্তু সমাজ ভুলে যায়, পুরুষের পাশাপাশি নারীর মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলে জাতির উন্নয়ন তরান্বিত হবে। এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ উভয়কেই গুরুত্ব দিতে হবে।
নারীর অভিমতের প্রতি পরিবার কতটা শ্রদ্ধাশীল, তার পূর্ণ সাক্ষাৎ ঘটে বিয়ে সংক্রান্ত বিষয় উত্থাপিত হলেই! বাঙালি সমাজে আজও পর্যন্ত নারীকে অন্তঃপুরের বাসিন্দা হিসেবেই গণ্য করা হয়। তাই বিয়ে, সামাজিক বিচারসভাসহ বড়-বড় ইস্যুতেও সাধারণত তার অভিমত নেওয়া হয় না। যদিও এ ব্যাপারে বর্তমানে সামাজিক ট্যাবু ভাঙতে শুরু করেছে। কিন্তু প্রত্যেক পরিবার থেকে যদি চর্চা শুরু না হয়, তবে নারীর মুক্তি অসম্ভব। পড়াশোনার বিষয়েও নারীর মতের গুরুত্ব দেয় না পরিবার। তাই বেশিরভাগ মেয়েরা নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পরিবারের দায় কাঁধে তুলে নেয়। এরফলে মানসিকভাবে প্রচণ্ড বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে। এতে ঘটছে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। নারীর অভিমতের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সহযোগিতার হাত বাড়ালে তবেই উন্নতি হবে।
সন্তান ধারণ ও লালন-পালন ক্ষেত্রে প্রায় নারীর মতকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এতে পারিবারিক অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। এমনকি সন্তানের শিক্ষার ব্যাপারেও নারীর মতকে অস্বীকার করে পরিবারের পুরুষ সদস্যরা। ফলে নারী মুক্তির পথ পরিবার থেকেই রুদ্ধ হয়ে থাকে। পরিবার থেকে যেহেতু নারীর বেড়ে ওঠা। তাই তার সামাজিক, পারিবারিক অস্থিতিশীল অবস্থার জন্য পরিবারই দায়ী। পরিবার পরিচালনার দায়িত্ব নারীর ওপর থাকলেও তার কাজের প্রতি পুরুষের মূল্যায়ন নেই। যা অসন্তোষের জন্ম দেয়। আর পরিবারে অস্থিতিশীল অবস্থার সৃষ্টি করে।
পেশা নির্বাচন ও চলাফেরায় নারী স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। বাঙালি জাতির ইতিহাসের দিকে লক্ষ্য করলেই জানা যায়। এক্ষেত্রে নারীর মতের কোনো গুরুত্বই দেওয়া হয় না। কিন্তু মানবজাতির উন্নয়ন ঘটাতে চাইলে নারীর প্রতি সহনশীল হতে হবে।
সবশেষে একটি কথা বলা প্রয়োজন, তাহলো, পারিবারিক-সামাজিক-ব্যবসায়িকভাবে যেসব চুক্তি বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে হয়, তাতে নারীর মতকে গ্রহণ করতে নারাজ পুরুষ জাতি। ফলে একতরফাভাবে পুরুষের ইচ্ছানুযায়ী এসব ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, ব্যবসা যদি হয় অর্থ উপার্জনের ক্ষেত্র, সেখানে যদি নারী-পুরুষ; উভয়ের স্বার্থ থাকে, তাহলে সেখানে নারীর মতকে অবদমন করে রাখা যাবে না। এছাড়া নারী নেতৃত্বের প্রতিও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। তাহলে নারীর জীবন স্বাভাবিক হবে। নারীর প্রতি সংবেদনশীল হলে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র সঠিকভাবে চলবে। নারীর জীবনকে সুন্দর করতে পরিবারের সুশিক্ষা অন্যতম। পরিবার থেকে পরিবর্তন হলে তবেই কর্মক্ষেত্রে, চলতি পথে সমস্যাহীন পৃথিবী গড়ে তোলা সম্ভব।