মেলিসা রায়ের বিশ্বভ্রমণ
সারা পৃথিবী ঘুরে দেখার স্বপ্ন পূরণের চেষ্টায় আছেন কত শত মানুষ। তাদের মাঝে অনেকেই আছেন শহরে শহরে, দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আর কেউ আছেন চমকে দিচ্ছেন! আবেগ ও ইচ্ছার মিশেলে তাদের ভ্রমণ ঠাঁই করে নিতে পারে যেকোনো জায়গাতেই। ভ্রমণের ক্ষেত্রে বাঙালির তেমন সুনাম নেই। বাঙালি অভিযাত্রী খুব বেশি খুঁজে পাওয়াও মুশকিল। 'ঘরকুনো বাঙালি' কথাটি কি আদৌ সত্য?
সে-কথা বলা যাবে না বাঙালি বংশোদ্ভূত মেলিসা রায়কে দেখলে। মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই জাতিসংঘের ১৯৩ সদস্য দেশেই পা রেখেছেন। ঘুরে দেখেছেন, অল্প সময়ে। তা কিভাবে সম্ভব? সারা পৃথিবীই এত অল্প সময়ে ঘুরে দেখা সম্ভব? তা-ই করে দেখালেন মেলিসা।
পুরো নাম তার মেলিসা সুমিত্রা রায়। হঠাৎই পৃথিবী দেখার ইচ্ছে থেকে তাঁর এই ভ্রমণ শুরু। একবার ভেবেই দেখুন, পরিণত বয়সে আমরা কত স্বপ্ন দেখি, কতটুকুই-বা ছোঁয়া সম্ভব হয়? অথচ একটু চেষ্টাতেই তা ধরা সম্ভব। শুধু হাতটুকু বাড়িয়ে দিতে হয়। ঘোরগ্রস্ত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য ২০০৪ সালে তাঁর ভ্রমণ শুরু। প্রথম গন্তব্য আর্জেন্টিনা। তবে সেটাকেও আদৌ স্বপ্ন পূরণের প্রচেষ্টা বলা চলে না। নিজের ভ্রমণের ইতি টানেন বাংলাদেশে এসে। সেটাই বা কেন? শেকড়ের টান অবশ্যই। নিজ বাবার দেশে যেন সমাপ্তি টানতে চেয়েছিলেন এই ভ্রমণের।
মেলিসার এই অদ্ভুত গল্পটিই একবার দেখা যাক। শুরুটা ২০০৪ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্জেন্টিনা ঘুরে আসার সুযোগ হয়। ভালো লেগেছিল সেবারের ভ্রমণ। কিন্তু ভ্রমণ নিয়ে তখনো এত কিছু ভাবেননি। বরং লেখাপড়া আর অন্যান্য ব্যস্ততাই যেন সঙ্গী। ঠিক তিন বছর পর ২০০৭ সালে এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। সমুদ্রপথে কাটিয়ে দেন প্রায় ১০০ দিন। একা তো অবশ্যই না। মেলিসার সঙ্গী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের আরো কিছু শিক্ষার্থী। সেবারের ভ্রমণে প্রায় ১২টি দেশ ঘোরা হয়ে যায়। ঘোরা মানে অন্তত পা ফেলে আসা হয়। আর এই এক অভিজ্ঞতা থেকেই ঘোরাঘুরির শখ মাথায় জেঁকে বসে। অনার্স শেষ হতেই ব্যাকপ্যাক নিয়ে ট্যুর দেয়া শুরু করলেন ইউরোপে। বহির্বিশ্বে একে ব্যাকপ্যাক ট্যুর বলে। এর মানে হলো, বেশ কম খরচে বিভিন্ন জায়গা ঘোরা।
ভ্রমণের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা খুবই প্রয়োজনীয় বিষয়। ইউরোপে ভ্রমণ তাঁকে সেই অভিজ্ঞতাই দিয়েছিল। কিন্তু একটানা ভ্রমণ করাটা সহজ না। এর মাঝে কিছু দিন আবার বিরতি। যাত্রা শুরু আবার ২০১৪ সালে। এতদিন কাজকর্ম করে টাকা জমিয়েছেন। ক্যালিফোর্নিয়ার হলিউডে থাকায় কখনো কাজ করেছেন বিজ্ঞাপনের মডেল হিসেবে। মাইক্রোসফট, ইনটেল, টি মোবাইলের মতো প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে মডেল হিসেবে কাজ করেছেন। পাওয়া অর্থ তিনি নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে বিনিয়োগ করেছেন। কখনো করতে হয়েছে চাকরি। ফেসবুক ও অ্যাপলের শেয়ার কিনে যা লভ্যাংশ পেয়েছেন, তা দিয়েই তাঁর এই বিশ্বভ্রমণ।
২০১৪ সালে ঘুরতে এলেন ভারত। কিন্তু এসেই জানতে পারলেন, বাবা সুভাষ চন্দ্র সাহা মারা গেছেন। ভ্রমণ থামিয়ে ফিরতে হলো সেই যুক্তরাষ্ট্রে। শোক কাটিয়ে আবার শুরু তাঁর ভ্রমণ। ভাবলেন ত্রিশের আগেই এক শতম দেশে পা রাখবেন। রেখেছিলেন। শ্রীলঙ্কাই ছিল তাঁর শততম ভ্রমণ। সৌদি আরবে পৌঁছনোর পর বাকি থাকে আর একটি দেশ। সেটি বাংলাদেশ। নিজের বাবার মাতৃভূমি, সেটা তো নিজেরও। তাই এই শেষ ভ্রমণটি ছিল অনেক আবেগের এবং আকাঙ্ক্ষিত একটি ভ্রমণ।
বাংলাদেশে এসেই এক নাটকীয় উদযাপন করলেন। সমুদ্রের তটে ইংরেজিতে ১৯৩ লিখে বঙ্গোপসাগরের দিকে মুখ করে তাকানো একটি মেয়ে। দুই হাত দিয়ে লাল-সবুজের প্ল্যাকার্ড ধরা। সে প্ল্যাকার্ডেও লেখা একটি সংখ্যা '১৯৩'। বাংলাদেশ ভ্রমণ মেলিসার জন্যে ছিল এক চমৎকার আবেগময় অনুভূতি। বাবা নেই, কিন্তু বাবার ভিটে নেত্রকোণা আছে। সেখানে হয়তো আর আবাসন নেই তাঁদের, তবু টিকে আছে বাবার শেকড়, মানে বন্ধুরা। বাবার স্মৃতি কিছুটা নেওয়া যাবে হয়তো।
শেষ হলো মেলিসার বিশ্বভ্রমণ। অন্তত বিশ্বের ১৯৩টি স্বাধীন রাষ্ট্রেই তাঁর পা পড়েছে। আর এই সময়ে কখনো ছিলেন অ্যান্টার্কটিকায় পেঙ্গুইনের সাথে খেলাধুলায় ব্যস্ত সময় ব্যয় করেছেন, করেছেন স্কুবা ডাইভিং, স্কাইডাইভিং এবং আরো অনেক কিছু। সমগ্র বিশ্বে একা একা একজন নারী হিসেবে ভ্রমণের ঝুঁকি আছে। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক নারীই একা একা ভ্রমণের কল্পনা করতে পারে না। নিরাপত্তার ঝুঁকি তো থেকেই যায়। কিন্তু সেখানে মেলিসা যেন ভীষণ ব্যতিক্রম। তাঁর এই ভ্রমণ যেন দেখিয়ে দেয়, সৎসাহস ও ইচ্ছে থাকলে কিছুই আসলে কঠিন বা ঝুঁকিপূর্ণ না।