‘২৪ সেকেন্ডের ভিডিওর বাইরে আরও ঘটনা আছে’
বাসে একা একটি মেয়ে প্রতিবাদ করছে, আর পুরো বাসভর্তি মানুষ তাকিয়ে দেখছে। তবুও দমে যাওয়ার পাত্রী নন প্রতিবাদী সেই মেয়ে। একাই আওয়াজ তুলে যাচ্ছেন তার সাথে ঘটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ২৪ সেকেন্ডের এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। তবে সেই ২৪ সেকেন্ডের ভিডিওর আড়ালে আছে আরো ঘটনা।
বাসে হয়রানির শিকার হওয়া সেই মেয়ের নাম কাজী জেবুন্নেসা কামাল (নেহা) । সেই দিন ঘটে যাওয়া ঘটনা নিয়ে তিনি পাক্ষিক অনন্যাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, "রবিবার বাসে যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, তার মাত্র ২৪ সেকেন্ড সবাই দেখতে পেয়েছে। যা এই ঘটনার সামান্য একটা অংশ মাত্র৷ এর বাইরে অনেক কিছু ঘটেছে। "
রাজধানীর শনির আখরায় মা ও বড় ভাইয়ের সাথে মামার বাড়ি গিয়েছিলেন নেহা। তাদের ফেরার কথাও ছিলে একসাথে। তবে ভাইয়ের কাজ থাকায় মা আর বোনকে রেখে আগেই চলে আসতে হয় তাকে। এরপর শনির আখরা থেকে কল্যানপুর আসার জন্য মৌমিতা পরিবহনের একটি বাসে উঠেন তারা মা-মেয়ে। বাসে আসন ফাঁকা না থাকায় বেশ কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় তাদের। এরপর ইঞ্জিনের পাশে একটি আসন ফাঁকা হলে সেখানে মাকে বসিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন নেহা।
একপর্যায়ে ভেতরের দিকে একটি আসন ফাঁকা হলে নেহা সেখানে গিয়ে বসেন। সব ঠিকঠাক চললেও আজিমপুরের কাছাকাছি এসে ঘটে এ ঘটনা। তার পাশের সিটে বসা লোকটি কয়েকবার তার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে। নেহা তাকে বেশ কয়েকবার সতর্ক করার চেষ্টা করলেও, প্রত্যেকবার লোকটি বোঝানোর চেষ্টা করে বিষয়টি ভুলবশত হচ্ছে। এক সময় নেহা মাথা ব্যথার কারণে চোখ বন্ধ করে জানালার সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে। লোকটি ভাবে নেহা ঘুমিয়ে পরেছে আর এই সুযোগে আবারও তার গায়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করে। তখনই নেহা উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে।
নেহার কথায়, " যখন আমি বুঝতে পারি এখন লোকটি পালিয়ে যাবে। আমি তার টি-শার্ট ধরে আটকে রাখি আর তাকে জিজ্ঞেস করি গায়ে হাত দিলি কেন? লোকটি স্বীকার করে নেয় তিনি দোষ করেছেন, তার ভুল হয়েছে৷ কয়েকবার ক্ষমা করে দিতে বলেন। কিন্তু আমি তাকে এতো সহজে ছেড়ে দিতে চাইনি।"
পুরো বাসভর্তি মানুষ থাকলেও নেহার জন্য কৌতুহলবশতও এগিয়ে আসেননি কেউ। নেহার দেয়া সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, বাসে উপস্থিত সকল সদস্য তখন বসে বসে সিনেমা উপভোগ করার মতো মজা নিচ্ছিলেন। কেউ নিশ্চুপ ভূমিকায় থাকলেও কেউ কেউ মন্তব্য করেন, "হাঁটুর বয়সী একটা মেয়ে এত বড় একজন মানুষের গায়ে হাত দিচ্ছে।" কেউ বলেন, "লোকটিকে দেখে তো ভালোই মনে হচ্ছে।" কেউ জিজ্ঞেস করেন, " গায়ে হাত দেয়ার কোনো প্রমাণ আছে ?"
বাসের যাত্রী বা হেল্পার কারো থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাননি নেহা। তার মা নিজের আসন থেকে উঠে এসে নেহার পাশে দাঁড়ান। বাসের বাকি সব যাত্রীরা তাকে সাহায্য না করে উল্টো বলেন, মাফ চেয়েছে, মাফ করে দেন। একসময় মাফ চেয়ে বাস থেকে নেমে যান ঐ লোকটি। কিন্তু ঘটনা এখানেই শেষ নয়। এরপরও বাসের মধ্যে মৌখিক হয়রানির শিকার হতে হয় তাকে। বাসের যাত্রীরা নানান ধরনের মন্তব্য করেন তাকে নিয়ে।
নেহার মা সব যাত্রীদের উদ্দেশ্যে বলেন, "আমার মেয়ে একা প্রতিবাদ করে গেলো আপনারা একটা মানুষও সাহায্য করলেন না। আপনারা এতগুলো পুরুষ চুপচাপ বসে বসে দেখলেন।" এমন সময় কয়েকটি ছেলে যাত্রী উল্টো তাকে ভয় দেখিয়ে বলেন, পুরো ঘটনার ভিডিও তাদের কাছে আছে, ভিডিও মিউট করে বিভিন্ন গ্রুপে দিলে ভাইরাল হয়ে যাবে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাসে শেষমুহুর্তে ওঠা আরেক নারী যাত্রী (তানজিয়া হাসান) নেহাকে তার ধারণ করা একটি ভিডিও নিজের নিরাপত্তার জন্য হলেও নিয়ে রাখতে বলেন। এরপর মূলত নেহা নিজের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি শেয়ার করেন৷ আর সেই ২৪ সেকেন্ডের ভিডিও এখন ভাইরাল।
এই ঘটনা নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনার সৃষ্টি হয়, অনেকে নেহাকে বাহবা জানায় তবে এক শ্রেনির লোক বরাবরের মতই প্রশ্ন তোলেন মেয়েটির চরিত্র নিয়ে, পোশাক নিয়ে, পরিবার নিয়ে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায় বিভিন্ন ধরনের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য। গতানুগতিক ধারায় ভিকটিম ব্লেমিং এর শিকার নেহা। যার কারণে পরিবারসহ নিজে ভুগছেন মানসিক অশান্তিতে। তবুও হার মানার পাত্রী নন তিনি।
তার ঘটনা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে বহু নারীকে। ছোটোবেলা থেকেই প্রতিবাদী নেহা। পরিবারও মুখ লুকিয়ে চলতে শেখায়নি তাকে। এর আগেও অনেক বার প্রতিবাদ করেছেন, এর পরেও ভবিষ্যতেও যেকোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে এভাবেই প্রতিবাদ করতে চান নেহা।