গ্র্যান্ডমা এমা গেটউড: জীবনের প্রান্তে থেকেও অভিযাত্রী
পাশ্চাত্যে হাইকিং কিংবা ট্র্যাকিং বেশ স্বাভাবিক ব্যাপার। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রে হাইকিং এর অনেক জায়গা খুঁজে পাওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্রেই অ্যাপালেশিয়ান ট্রেইল নামে একটি বিপজ্জনক ট্রেইল খুঁজে পাওয়া যাবে। জর্জিয়া থেকে শুরু হয়ে ২,০৫০ মেইল দীর্ঘ এই ট্রেইল অতিক্রম করা মোটেও সহজ কিছু না। এই ট্রেইলকে জয় করার জন্যে বহু দক্ষ হাইকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যান। ভেবে দেখুন না! প্রতি বছর অন্তত হাজার জন হাইকার এই ট্রেইল জয়ের চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতি চারজনে একজনের পক্ষে এমন কাজ করা সম্ভব হয়।
স্বভাবতই তরুণ কিংবা প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর কারো পক্ষে এই ট্রেইল জয় করা সম্ভব। কিন্তু কোনো বৃদ্ধা যদি সে চেষ্টা চালায়? স্বভাবতই তাকে ব্যর্থ হতে হবে। কিন্তু না! গল্প বাকি আছে এখনো। এই দীর্ঘ পথ একবার নয়, তিন তিনবার অতিক্রম করেন ৬৭ বছর বয়সী এক নারী। পরবর্তীতে বেন মন্টগোমারি তাকে সমগ্র বিশ্বে পরিচিত করবেন "গ্র্যান্ডমা গেটউড" নামে। কে এই নারী? আর কেনই বা বৃদ্ধ বয়সে তার এমন দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা? সে কথাই আজ জানা যাক।
পুরো নাম তার এমা রোয়েনা ক্যাল্ডওয়েল। ১৮৮৭ সালের ২৫ অক্টোবর ওহাইওতে গ্যালিয়া কাউন্টিতে জন্ম। বাবা হিউ ক্যাল্ডওয়েল পারিবারিক খামারের দেখভাল করতেন। কিন্তু গৃহযুদ্ধেই তিনি এক পা খুইয়ে বসেন। সম্ভবত যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব তাকে মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে তুলেছিলো। মদ আর জুয়ায় সারাদিন বুঁদ হয়ে থাকা ছাড়া আর কিছুই করতেন না। পরিবারে ১৫ টি সন্তান। মা ইভলিন সন্তানদের দেখভালেই ব্যস্ত থাকতেন।
এমার বয়স ১৯ হতেই পেরি ক্লেটন গেটউড নামে এক ২৬ বছর বয়স্ক যুবকের সাথে তার বিয়ে হয়। ক্লেটন প্রথমে শিক্ষকতা করতেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি কৃষিকাজে জড়িয়ে পড়েন। জন্মের পর থেকেই এমা কৃষিকাজের সাথে জড়িত। ট্রেইলের পরিবেশ ও আবহাওয়া তাকে টিকিয়ে রেখেছিলো। গাছপালা সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকায় ট্রেইলে এমা টিকে থাকতে পেরেছিলো।
অন্য আর নারীর মতো এমার জীবনকে এতটাও বর্ণিল বলা চলেনা। বিয়ের পর ৩০ বছরের সংসার। এই দীর্ঘ সময়ে স্বামীর হাতে প্রতিনিয়ত নৃশংস নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিলো এমাকে। এই নির্যাতনের থেকে মুক্তির জন্যে মুখ ফুটে প্রতিবাদও করেছিলেন। কিন্তু তাতে লাভ হয়নি। উলটো গ্রেফতার হতে হয়েছে তাকে। পরবর্তীতে ডিভোর্সের মাধ্যমে এই নির্যাতন থেকে মুক্তিলাভ হয়েছিলো। পুরো অর্ধশতাব্দিজুড়ে পুরো পৃথিবীর মানুষ এমার এই ঘটনা জানতেই পারেনি। অবশ্য পৃথিবীর অসংখ্য নারীর গল্পই তো আমাদের জানা নেই। কিন্তু ২০১৪ সালেই বেন মন্টগোমারি 'গ্র্যান্ডমা গেটউডস ওয়াক' নামে একটি বই প্রকাশ করে। আর সেখানেই পুরো যুক্তরাজ্যের মানুষ অবাক হয়ে খেয়াল করে ৬৭ বছর বয়স্ক এক নারী কিভাবে পৃথিবীর অন্যতম বিপদশঙ্কুল ট্রেইল পার করেছেন।
এই বইটি থেকেই আমরা এমার ভয়ংকর পারিবারিক জীবনের গল্প জানতে পারি। এমার সন্তানদের রেখে যাওয়া জার্নাল থেকে টুকরো টুকরো গল্পগুলোই আমাদের এই সহিংসতার কিছুটা আভাস দেয়। বেন জানতে পারেন, এমার স্বামী বিয়ের তিন মাস পর থেকেই নির্যাতন শুরু করে। কামাতুর বাবা মাকে দিনে বেশ কবার সহবাসে লিপ্ত হতে বাধ্য করতেন। এই ভয়ংকর যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতেই তিনি বাড়ি ছেড়ে পালান। তবে বাড়িতে দুই কন্যাসন্তানকে বাবার কাছেই রেখে গিয়েছিলেন। ভালোমতোই জানা, বাবা সন্তানদের গায়ে হাত তুলবেন না। কিন্তু মায়ের মন তো সহজে মানে না। সন্তানের মায়াই তাকে আবার বাড়ি ফিরিয়ে আনে।
এমনকি এমার নিজেরও কিছু লেখা ছিলো। ১৯৩৮ সালেই আকি তার স্বামী এমন ভয়ংকর মারধোর করে যে এমার চেহারাই বিকৃত হয়ে গিয়েছিলো। আবার ১৯৩৯ সালেই স্বামীর মারের চোটে এমার দাঁত আর পাজরের হাড় ভেঙে যায়। সহ্যেরও একটা সীমা থাকে। এই নির্যাতন থেকে মুক্তির জন্যে এমা শেষবারের জন্যে স্বামীর দিকে ময়দার বস্তা ছুড়ে মারেন। এমার অবস্থা খারাপ। কিন্তু পুলিশ এমাকে দেখেও তার স্বামীকে অভিযুক্ত করেনি। উলটো স্বামীর দিকে ময়দার বস্তা ছুড়ে মারার অপরাধে পুলিশ তাকে কারাগারে নিয়ে যায়। এমার কিছুই করার নেই। কিন্তু শহরের মেয়রের ঠিকই নজরে পড়েছিলো। তিনি এমাকে নিজের বাড়ি নিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। এবার আর এমা সহ্য করলেন না। ডিভোর্সের আবেদন করবেন মনস্থির করা হয়ে গেছে। ১৯৪১ সালে এই আবেদন মজুর হয়। অবশেষে এমা এই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পান।
জীবনের আর কি বাকি আছে? কিছুই না। এবার কি মৃত্যুর অপেক্ষা? আর এখানেই এমা অনন্যা। জীবনের প্রান্তিক মুহূর্তেই এমা যেন নিজেকে পর্যটক বানিয়ে নিলেন। নিজেকে পর্যটক বানিয়ে নিলেন। ১৯৪৯ সালেই তিনি অ্যাপালেশিয়ান ট্রেইলের কথা জানতে পারেন। জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনের একনিষ্ঠ এই পাঠক যেন সমগ্র বিশ্বের কাছেই ছড়িয়ে পড়তে চাচ্ছিলেন। এই ট্রেইল এখনো কোনো নারী পার করেনি। তাই সারাজীবন নির্যাতিত হলেও এই প্রথম কোনোকিছুতে প্রথম হওয়ার তীব্র আকাঙ্ক্ষা তাকে পেয়ে বসে। কিন্তু হাইকিং তো আর অত সহজ কিছু না। মূলত পায়ের মাংসপেশির শক্তি বাড়াতে হবে। এবার প্রতিদিন সে দশ মেইল করে হাটা শুরু করলেন।
১৯৫৪ সালে এমা এই ট্রেইল জয়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু যাত্রাপথে তার চশমা ভেঙে যায়। বয়স হয়েছে – অবশ্যই চোখের জ্যোতি কমে গেছে। মাঝপথে তাই তিনি পথ হারিয়ে ফেলেন। ভাগ্যিস রেঞ্জারদের একটি দল তাকে উদ্ধার করেছিলো। কিন্তু যার জীবনের বিশাল একটি সময় শারীরিক নির্যাতন ও মানসিক যন্ত্রণায় কাটাতে হয়েছে – তাকে কি শান্ত পর্বত থামাতে পারে কোনোভাবে? অবশ্যই না। পরের বছর জর্জিয়া থেকে তার যাত্রা শুরু হয়। ১৯৫৫ সালে ৬৭ বছর বয়সে তিনি এই ট্রেইল জয় করেই সমগ্র বিশ্বকে তাঁক লাগিয়ে দেন। সন্তানদের অবশ্য এই যাত্রার কথা ঘুনাক্ষরেও জানতে দেননি। স্বাভাবিক! হয়তো বাধার সম্ভাবনা ছিলো। বৃদ্ধ বয়সে তো আমেরিকান বৃদ্ধ বা বৃদ্ধাদের অনেক বাধাবিঘ্নের মুখোমুখি হতে হয়। পত্রপত্রিকায় মার সাক্ষাৎকার দেখেই সবাই অবাক।
এমার কাছে অত্যাধুনিক কোনো সরঞ্জামাদি ছিলোনা। নিজের হাতে সেলাই করে একটা ছোট ড্রস্টিং ব্যাগ তৈরি করেছিলেন। যাত্রার জন্যে একেবারে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রই তিনি ব্যাগে ভরে নেন। গোসলের জন্যে প্রয়োজনীয় প্লাস্টিকের পর্দা, সুইস আর্মি নাইফ, ফ্ল্যাশলাইট, ব্যান্ড এইট, কলম, আয়োডিন ও ছোট নোটবুক ছাড়া আর কিছুই নেননি।
খাবারের জন্যেও তিনি ভিয়েনা সসেজ, কিসমিস, বাদাম ও বুলিয়ন কিউব কিনে নেন। এমনকি সাত জোড়া কাপড়ের কেডসও নিয়েছিলেন। এমা কোনো তাবু নেননি। বরং নতুন মানুষদের সাথে পরিচিত হওয়া এবং তাদের আতিথেয়তার প্রতি আস্থা ছিলো তার। এই বৃদ্ধা রাতারাতি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। দীর্ঘ ১৪৬ দিন গড়ে ১৪ মেইল হাটার পর অবশেষে এই ট্রেইল তিনি পার করেন। সংখ্যাটি দেখে এত সহজে মুগ্ধ হতে পারবেন না। সমস্যা নেই। আমরা একটু তুলনা করে বোঝাই। বয় স্কাউটের একটি পুরো দল এমার সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে ব্যর্থ হয়। যে সময় তিনি এমন গতিতে ট্রেইল পার করছেন তখন বাড়িতে ১১ সন্তান। আর ২৩ নাতী নাতনীও ততদিনে দিদিমার অপেক্ষায়। এই অ্যাপালেশিয়ান ট্রেইল বাদেও এমা ২০০০ মেইল দীর্ঘ অরিগন ট্রেইল অতিক্রম করেন। নিজের প্রচেষ্টার কারণে তিনি "আমেরিকাস মোস্ট সেলেব্রেটেড পেডেস্ট্রিয়ান" হিসেবে খ্যাতি পেয়ে যান। এমার যাত্রা শুরু হয়েছিলো প্রোঢ় বয়সে। কিন্তু ১৯৭৩ সালেই ৮৫ বছর বয়সে এমা গেটউড মৃত্যুবরণ করেন।
নতুন পৃথিবীর এই যাত্রা কেমন তা হয়তো আমরা জানতে পারবোনা। কিন্তু এমার এই দুঃসাহসিক অভিযাত্রা সমগ্র বিশ্বের নারীদের যেন নতুন এক অনুপ্রেরণা দেয়। বয়স হয়ে গেলে নারীর কোনো মুল্য নেই? ঘরে নাতী নাতনী নিয়েই কোনোমতে শান্তিতে দিন গুজরানো যায় তাইনা? অবশ্যই না। বরং নতুনভাবে কিছু করাও যেতে পারে। এমার জীবন হয়তো বিশাল এক সময় পর্যন্ত বর্ণিল কিছু জানায় না। কিন্তু এখানেই আমরা ভুল। দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে পারিবারিক গঞ্জনা, যন্ত্রণা ও দুঃসাহস থেকেই তার দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়। গ্র্যান্ডমা গেটউড আমেরিকান নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ ও বৃদ্ধাদের জন্যেও এক অনুপ্রেরণা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এমা শুধু নারীদের জন্যেই এক চিরস্মরনীয় চরিত্র না। বরং এমন এক অভিযাত্রী – সে কিনা জীবনকে বর্ণিল করার মনো দৃঢ় মনোভাব ধরে রাখতে জানেন।